আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে স্থূল নারী ও শিশুর সংখ্যা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.04.14
160414_BD_wonen_620.JPG বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন বিবাহিত নারীর একজন স্থূলকায় বা বেশি ওজনের।
Photo: Benar

বাংলাদেশের মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছেন। অপুষ্টিতে ভোগা দুর্বল মানুষের দেশটিতে ক্রমশ অতিপুষ্টির কারণে স্থূল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যানসার রোগীর সংখ্যা।

গবেষকেরা বলছেন, স্থূল পুরুষের সংখ্যা এখনও বিপজ্জনক মাত্রার চেয়ে কম। কিন্তু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে স্থূল নারী ও শিশুর সংখ্যা।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) আলাদা আলাদা ভাবে নারী ও শিশুদের ওপর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন বিবাহিত নারীর একজন স্থূলকায় বা বেশি ওজনের।

সরকারের জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচি আইপিএইচএন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়  আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, মহানগরগুলোতে এখন প্রতি ১০০ শিশুর ১৪টির ওজন বেশি। কমপক্ষে চারজন স্থূল। গত বছরের মার্চে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাহমুদুর রহমান মনে করছেন, মুটিয়ে যাওয়া বা স্থূলতা স্বাস্থ্যখাতের বিদ্যমান সমস্যায় নতুন সংযুক্তি। কেননা বাংলাদেশে অপুষ্টির সমস্যা এখনও নির্মূল হয়নি। অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ সংক্রামক রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে স্থূলতার কারণে বছর বছর অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে।

মাহমুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি বিকল হওয়া, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্বাস্থ্যখাতের বাজেট কম। ফলে এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে আক্রান্ত রোগী যেমন, রাষ্ট্রও তেমনি বিরাট ঝুঁকিতে পড়বে।”

মুটিয়ে যাওয়ার কারণ

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১১ ও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। ১৮-৪৯ বছর বয়সী নারীরা কেন মুটিয়ে যাচ্ছেন তার কারণ খুঁজে বের করেন আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা।

আইসিডিডিআরবি বলছে, ১৬ হাজার ৪৯৩ জন নারীর মধ্যে ১৮ শতাংশের ওজন বেশি। শহরে থাকেন এবং কর্মজীবী নন এমন নারীদের স্থূলকায় হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

‘ওবেসিটি প্রিভালেন্স অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস ইন আরবান এরিয়াস ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের সাতটি সিটি করপোরেশনের ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৪ হাজার ১০০ শিশুর ওপর ও জরিপ চালায়।

গবেষকেরা শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে  ক্যালরি-সমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া এবং দৈনিক কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে খেলাধুলা না করাকে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন দেখা, কম্পিউটার ও মুঠোফোনে ভিডিও গেমস খেলার নেশা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

আইসিডিডিআরবির পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বেনারকে বলেন,” কোনো দেশ যখন ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাঁটে, তখন দেশটিতে বেঁটে হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা কমে আর মুটিয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা বাড়ে।“

“এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একই সঙ্গে দুই ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে। একদিকে আছে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, অন্যদিকে মুটিয়ে যাওয়া শিশু। বাংলাদেশে স্থূলতার সমস্যা প্রকট হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন,” জানান তাহমিদ।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি

স্থূলতার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আর ডায়াবেটিসকে বলা হয় ‘মাদার অব অল ডিজিজেস’। ডায়াবেটিসে ভোগা মানুষ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে কিডনি বিকল হওয়া, অন্ধত্ব, চামড়ার রোগ, হৃদরোগ এমনকি যক্ষ্মাতেও বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন বেশি।

গতবছরের নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন ডায়াবেটিসের প্রকোপ থাকা ১০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করে। তালিকার শীর্ষে আছে চীন, ১০ নম্বরে বাংলাদেশ।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের শিক্ষক সোহেল রাজা চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশেরও বেশি ঘটছে অসংক্রামক ব্যাধি থেকে। অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে হৃদরোগ। হৃদরোগকে বলা হয় খাদ্যবাহিত রোগ। ওজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ।”

বারডেম জেনারেল হাসপাতাল পেডিয়াট্রিক এনড্রোকাইনোলজি বিভাগের প্রধান ফৌজিয়া হোসেন স্থূলতার কারণে ভুগছে।এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “টাইপ টু ডায়াবেটিসের পাশাপাশি অনেক শিশু এখন উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগে ভুগছে। অনেকের যকৃতে চর্বি জমে গেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এই শিশুরা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে।”

এ ছাড়া চিকিৎসকেরা আরও বলছেন, শিশুরা কালো হয়ে যাওয়া বা মেয়েশিশুদের দাড়ি-গোঁফ থাকা কিংবা নিয়মিত মাসিক না হওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। অনেক অভিভাবক বুঝতেই পারেন না, এগুলো মুটিয়ে যাওয়ার কারণে হচ্ছে।

কিছু করণীয়

চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যসম্মত তেল-চর্বিবিহীন খাবার খাওয়ার পাশাপাশি, ব্যায়াম করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী বেনারকে বলেন, “ঢাকার বেশির ভাগ মানুষ হয় দালানকোঠার বস্তিতে থাকছে। এর মধ্যেই ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে। ছাদে বাগান করা যেতে পারে, বার্গারের বদলে ভেজিটেবল রোল খাওয়া যেতে পারে।”

ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপপরিচালক এ এইচ এস কে আলম বেনারকে  বলেন, “খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। রাজধানীর অভিভাবকদের অনেকেই একটা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাঁরা সন্তানদের ভালো স্কুলে দিচ্ছেন, কোচিংয়ে পাঠাচ্ছেন, অবসরে কম্পিউটারে খেলতে দিচ্ছেন। কিন্তু শিশুদের খেলার ব্যবস্থা করার কোনো উদ্যোগ কেউই নিচ্ছেন না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।