ট্রাক চাপায় ঘুমন্ত ১৩ শ্রমিক নিহত

পুলক ঘটক
2019.01.25
ঢাকা
190125_Accident_620.jpg কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কয়লাবাহী ট্রাকটি উল্টে একটি ঘরের ওপর পড়লে সেখানে ঘুমন্ত ১৩ জন শ্রমিক নিহত ও পাঁচজন আহত হন। ২৫ জানুয়ারি ২০১৯।
[ফোকাস বাংলা]

সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর প্রতিদিন প্রায় বিশজন মানুষ মারা গেছেন বলে জানিয়েছে যাত্রীকল্যাণ সমিতি।

শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি জানায়, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১৯.৭৮ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আর প্রতিদিন আহত হয়েছেন অন্তত ৪২ জন।

শুক্রবার সকালে এই তথ্য প্রকাশের ৬ ঘণ্টা আগে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি ট্রাক চাপায় ১৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও পাঁচ জন।

“এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণে দেশের আর্থিক ক্ষতি মোট জিডিপি’র ১.৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হন। সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব তথ্য তুলেন ধরেন।

সড়ক নিরাপত্তার সাথে জড়িতদের অভিযোগ, সরকার তাড়াহুড়া করে সড়ক পরিবহন আইন পাস করলেও তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিচ্ছে না। পরিবহন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার লোকজন, পুলিশ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতির দুষ্ট চক্র গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “দুর্নীতির দুষ্টচক্র, জবাবদিহির অভাব ও মালিক-শ্রমিকদের আইন না মানার প্রবণতা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।”

“সড়কে নামলে আমরা আইনের প্রয়োগ দেখতে পাই না। এমনকি আইনপ্রণেতারাও আইন মেনে চলেন না। এখনো সড়কে উল্টা পথে ভিআইপিদের গাড়ি দেখা যায়,” বেনারকে বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তড়িঘড়ি করে পাস করা হলেও সড়ক পরিবহন আইন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে কার্যকর হয়নি। নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের কথা থাকলেও নির্বাচনের পর সড়ক পরিবহনমন্ত্রী এই আইন নিয়ে কোনো কথাই আর বলেননি।”

প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই খানিকটা তাড়াহুড়া করে সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার।

ঘুমন্ত ১৩ শ্রমিকের মৃত্যু

শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কয়লাবাহী ট্রাক উল্টে একটি ঘরের উপর পড়লে ১৩ জন ঘুমন্ত শ্রমিক নিহত হন।

চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ বেনারকে বলেছেন, “ট্রাকটি ইটভাটায় কয়লা নিয়ে এসেছিল। ফেরার পথে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে ট্রাকটি উল্টে শ্রমিকদেরে একটি ঘরের ওপর পড়ে। সেখানে তাঁরা ঘুমাচ্ছিলেন।”

উপজেলার গোলপাশা ইউনিয়নের নারায়ণপুর এলাকায় কাজী অ্যান্ড কোং নামক ইট ভাটার পাশে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। চালক ও সহকারী পলাতক।

এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বৃহস্পতিবার তিনজন ও বুধবার ১৪জন নিহত হন।

গত বছরের মুত্যুর হিসাব তুলে ধরতে গিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, “এটা আংশিক হিসাব। কারণ যেসব দুর্ঘটনার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে শুধু সেগুলোই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিদিনের সকল দুর্ঘটনার খবর সংবাদপত্রে আসে না। মাত্র ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনার খবরে আসে।”

এক বছরে ৭৭৯৬ প্রাণহানী

যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সড়কে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ২২১ জন। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। এছাড়া সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশ পথে মোট ৬ হাজার ৪৮টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭৯৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৯৮০ জন।

তবে গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়লেও হতাহতের সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০১৭ সালে চার হাজার ৯৭৯টি দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জন‍ নিহত এবং ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছিলেন।

“মহাসড়কে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাওয়া ছাড়াও চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনার লাগাম টানতে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া এবং সড়ক বিভাগ সড়ক সংস্কারে নিষ্ক্রিয় থাকায় ভাঙাচোরা সড়কে দুর্ঘটনার হার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ।

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১২দফা সুপারিশমালা তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে গণমাধ্যমে এবং শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক প্রচারাভিযান, মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা; রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রাক্রসিং অংকন করা।

এছাড়া চালকদের প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা, যাত্রী ও পথচারীবান্ধব সড়ক পরিবহন বিধি প্রণয়ন; গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি আধুনিকায়ন, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, অনুমোদিত সড়ক পরিবহন আইন দ্রুত বাস্তবায়ন, সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠন করে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নকালে চালকের ডোপ টেস্ট করানো এবং পর্যাপ্ত মানসম্মত গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।