চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নয়, অবহেলা: হাইকোর্ট

পুলক ঘটক
2019.02.25
ঢাকা
190225_Fire_mourning_1000.jpg চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে চুড়িহাট্টার একটি রাস্তায় কালো পতাকা। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জনের মৃত্যুর ঘটনায় সোমবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।

একইদিন হাইকোর্ট বলেছে, “এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা অবহেলা। কাউকে না কাউকে এর দায় নিতেই হবে।”

চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিপূরণ প্রদান, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম অপসারণসহ কয়েক দফা নির্দেশনা চেয়ে রবিবার হাইকোর্টে দায়ের হওয়া তিনটি রিট আবেদনের শুনানিকালে আদালত এ কথা বলে।

আদালতের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করে রিট মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বেনারকে বলেন, “নিমতলির ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, তা বাস্তবায়ন হলে চকবাজারে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।”

প্রসঙ্গত, নিমতলিতে ২০১০ সালের ৩ জুনের অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মারা যান।

শুনানিকালে আদালত বলে, “ওইসব এলাকার বাড়ির মালিকেরা তিনগুণ বেশিতে গোডাউন ভাড়া দেন। আর নিজেরা থাকেন গুলশানে। মারা যায় গরিব মানুষ। সিটি করপোরেশন দেখেও না দেখার ভান করে।”

সবগুলো রিট এক সঙ্গে করে মঙ্গলবার আবারও শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।

আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ প্রকাশের দিনেই পুরান ঢাকার সব এলাকা থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে কেমিক্যালের মজুত সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।

এর আগে রবিবার হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানাতে জাতীয় সংসদে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতের ওই অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মধ্যে নয়জন এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

৭০ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিতে

চকবাজারের অলিগলি সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, সেখানকার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ভবনে বিভিন্ন দাহ্য পণ্য বা কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। ভবন মালিকরা বেশি মুনাফার লোভে আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত গোডাউন হিসাবে ভাড়া দিচ্ছেন।

‘ফ্যামিলি’ বাসার তুলনায় গোডাউন ভাড়া দিলে বেশি টাকা পাওয়া যায় উল্লেখ করে দেবিদাস ঘাট লেনের বাসিন্দা নুরু উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমি আমার ভবনে গোডাউন ভাড়া না দিলেও নিরাপদ থাকতে পারব না। কারণ আমার পাশের ভবনের মালিক ঠিকই ভাড়া দেবেন।

“বেশি টাকা ভাড়া পাওয়ার লোভ কেউ সামলাতে পারে না,” যোগ করেন তিনি।

নন্দ কুমার লেনের বাসিন্দা নেয়ামত বাহাদুর বেনারকে বলেন, “এলাকার সব মানুষ সচেতন না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।”

কারণ নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। এ নিয়ে নানামুখী ভাষ্য আসছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মফিজুল হক বেনারকে বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে আমরা জেনেছি, অগ্নিকাণ্ড যেখানে হয়েছে তার আশপাশে কেমিক্যালের কোনো কারখানা বা গোডাউন ছিল না। এলাকার লোকজন আমাদের সেই কথাই বলেছে।”

এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনও ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর বলেছিলেন, “গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা হয়েছে, কেমিক্যালের কারণে নয়।”

তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল জুলফিকার রহমান বেনারকে বলেছেন, “রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।”

এ ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে প্রকৌশলীদের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, “ওই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থের সম্পর্ক আছে সেটি দেখাতে চান না স্থানীয় বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীরা।”

১৯ লাশের দাবিদার ২৩ পরিবার

অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসাবশেষে পাওয়া ১৯টি লাশেরে পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি এখনও। অজ্ঞাত ওই মরদেহগুলোর দাবিদার আছে ২৩টি পরিবার। এই পরিবারগুলো অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাদের আপনজনদের খোঁজ পাচ্ছে না।

তারা সবাই অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ‘ডিএনএ’ পরীক্ষার মাধ্যমে এগুলোর পরিচয় শনাক্তের দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন অবধি ৩৮ জনের ‘ডিএনএ’ নমুনা সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো রেজাউল হায়দার সোমবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “১৯টি লাশের মধ্যে ১৪টি তাদের পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে অন্তত ১৫ দিন সময় লাগবে। বাকি পাঁচটি শনাক্ত করতে তিন সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।”

ওই পাঁচটি মরদেহ পুড়ে প্রায় কয়লায় পরিণত হয়েছে। সেগুলোর মাংসপেশি পাওয়া যায়নি, তাই হাড়ের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তা থেকে নমুনা সংগ্রহের পর্যায়ে আসতেই অন্তত তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। এরপর স্বজনদের ডিএনএর সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা শুরু হবে।

চকবাজার এলাকায় রিকশা চালাতেন শাহাবুদ্দিন নামে এক তরুণ। তার বাবা হাসান আলী সিআইডির কাছে ‘ডিএনএ’-র নমুনা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বেনারকে বলেন “ছেলেকে হয়ত আর পাব না। তবে ভালোভাবে কবর দিতে পারলেও একটা সান্ত্বনা থাকবে।”

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে

সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর গড়ে ১৪৯.৩০ জন মানুষ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বেনারকে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে মোট এক লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

এতে মোট এক হাজার ৪৯৩ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো ৭৫৪ জন।

ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী এসব অগ্নিকাণ্ডে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪২.৮৭ বিলিয়ন টাকা।

শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। মারা গেছেন ১৩০ জন, আহত ৬৭৭ জন এবং অর্থসম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩.৮৬ বিলিয়ন টাকা।

হিসাব পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত ১০ বছরের প্রায় প্রতিবছরই অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার ৯২৩টি বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।