এবার ভাসানটেকে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গেলো দুই শিশুর

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.02.28
ঢাকা
190228_Dhaka_fire_1000.JPG মিরপুরের ভাসানটেকে আগুনে পোড়া বস্তি। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬৯ জন নিহত হওয়ার সাতদিনের মাথায় এবার মিরপুরে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেলো দুই শিশু।

বৃহস্পতিবার ভোরে ভাসানটেক বস্তির এই অগ্নিকাণ্ডে দেড়শ’র বেশি টংঘরও পুড়ে গেছে বলে বেনারকে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

বস্তিবাসীদের অভিযোগ, তাঁদের উচ্ছেদ করতেই কৌশলে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়েছে। তবে পুলিশ বলেছে, আগুন লাগানোর কারণ এখনো জানা যায়নি।

এদিকে চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলো থেকে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থসহ সকল দ্রব্যাদির গুদাম সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।

সিটি কর্পোরেশন আগামী একমাস এই অভিযান অব্যাহত রাখবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

ভাসানটেকের অগ্নিকাণ্ড

প্রত্যক্ষদর্শী ও বস্তিবাসী রিকশাচালক মো. হালিম জানান, বুধবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মিরপুরের ভাসানটেক সিআরপি হাসপাতালের পেছনে জাহাঙ্গীর বস্তিতে আগুন লাগে। তখন বস্তিবাসীরা ঘুমিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “বস্তির পূর্বদিকে আগুন লাগে। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন থেকে বাঁচতে সবাই হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। যে যা পেরেছে হাতে নিয়ে পালাতে থাকে।”

হালিম বলেন, “অনেকের শিশু সন্তান হারিয়ে গেছে। টাকাপয়সা ও মূল্যবান কাগজপত্র পুড়ে গেছে।”

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নেভাতে চেষ্টা চালাতে থাকেন।

সারারাত চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিট সকাল আটটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

অগ্নি নির্বাপন কাজে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মানিকুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমরা সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছি।  আমরা পাশের ডোবা থেকে দুটি শিশুর লাশ উদ্ধার করেছি। একটি বাচ্চার বয়স তিন-চার মাস। আরেকটি শিশুর বয়স তিন-চার বছর হবে।”

তিনি বলেন, “যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের বের করতে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি।”

আগুন লাগানোর অভিযোগ

জাহাঙ্গীর বস্তির উল্টোদিকে আরেকটি বস্তি ছিল। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সেখানে উচ্ছেদ চালানো হয়। সেখানকার গৃহহীন মানুষ জাহাঙ্গীরের বস্তিতে আশ্রয় নেয়।

তবে বস্তিবাসীদের অভিযোগ, তাদের উচ্ছেদ করতে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে।

মহিউদ্দিন নামের আরেক বস্তিবাসী বেনারকে বলেন, “উচ্ছেদ করতে গেলে আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করব। সাংবাদিকরা আসবে। সমস্যা হবে। তাই রাতের আঁধারে আগুন লাগান হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা হাজার হাজার মানুষ একরাতে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। রাত থেকে বিকাল পর্যন্ত পেটে কোনো দানা-পানি পড়েনি। দেশে বিচার নাই। গরিবের আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই। আল্লার কাছে বিচার দিলাম।”

তবে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মানিকুজ্জামান বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত আগুনের কারণ জানতে পারিনি। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আপনাদের আগুন ধরার কারণ জানাতে পারব।”

তিনি বলেন, “টংঘরগুলোতে যেনতেনভাবে বৈদ্যুতিক তার টানা ছিল। সেখান থেকে আগুন লাগতে পারে। আবার মশার কয়েল থেকেও আগুনের সূত্রপাত  হতে পারে।”

তাঁর মতে, বৃষ্টির কারণে আগুনের প্রচণ্ডতা কম ছিল।

মিরপুরের ভাসানটেকে দরিদ্র মানুষের বসবাস। সেখানকার বস্তিগুলোতে অল্প ভাড়ায় বসবাস করে কয়েক হাজার মানুষ।

পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদ অভিযান। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদ অভিযান। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

রাসায়নিক গুদাম সরানো শুরু

ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে বিপদজনক রাসায়নিকসহ সকল প্রকার গুদাম সরাতে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।

বিপুল সংখ্যক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ইসলামবাগ ও শহীদবাগে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হয়।

হ্যান্ড মাইক দিয়ে অবৈধ গুদাম সরানোর ঘোষণা প্রচার করেন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফুল ইসলাম।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা আজ থেকে অবৈধ গুদাম উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছি। প্রথমদিনে শহীদবাগ ও ইসলামবাগের ১৯টি বাড়িতে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করেছি।”

তিনি বলেন, “যেহেতু ওই বাড়িগুলোতে অবৈধ গুদাম আছে তাই আমরা ওগুলোর পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। তারা আমাদের বাধা দিতে চেয়েছিল। আমরা তাদের অবৈধ গুদামগুলো সাতদিনের মধ্যে সরাতে বলেছি।”

প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “তারা যদি সাতদিনের মধ্যে এগুলো সরাতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

তিনি বলেন, আগামী একমাস এই উচ্ছেদ কার্যক্রম চলবে।

প্রধান নির্বাহী বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অবৈধ গুদামে রক্ষিত মালামাল শ্যামপুর ও টঙ্গিতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, আগামী ছয়মাসের মধ্যে কেরাণীগঞ্জে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম স্থাপন করা হবে।

তবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে লালবাগ এলাকার ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন বলেন, “আমরা শত বছর ধরে এই এলাকায় ব্যবসা করছি। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। এখান থেকে গুদাম-ফ্যাক্টরি সরালে এখানকার অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।”

তিনি বলেন, “আমরা বিপদজনক কেমিক্যাল রাখতে চাই না। কিন্তু অনেক কেমিক্যাল আছে যেগুলো দাহ্য নয়। যেমন ট্যালকাম পাউডার। এটাও সরাতে বলছে। আমাদের আপত্তি এখানেই।”

গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগলে পথচারিসহ ৬৭জন, পরে আরও দুজন মানুষ মারা যায়। আগুনে আহত হয় অর্ধশতাধিক।

এর আগে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলি এলাকায় রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।