মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ: এখনো কারণ জানা যায়নি

পুলক ঘটক
2021.06.28
ঢাকা
মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ: এখনো কারণ জানা যায়নি বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত রাজধানীর মগবাজারে বাণিজ্যিক দালান ‘রাখি নীড়’ এর ধ্বংসাবশেষে দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করছেন পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের কর্মকর্তারা। ২৮ জুন ২০২১।
[বেনারনিউজ]

রাজধানীর মগবাজারে এক বাণিজ্যিক দালানে রহস্যজনক বিস্ফোরণের সুনির্দিষ্ট কারণ সোমবার পর্যন্ত জানা যায়নি। রোববার সন্ধ্যার ওই বিস্ফোরণে মারা গেছেন শিশুসহ ৭ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক। 

“বিস্ফোরণে তিন তলা বিশিষ্ট ‘রাখি নীড়’ ভবনটি এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে, এটি আর মেরামতযোগ্য নয়। যে কোনো সময় ভবনটি পুরোপুরি ধসে পড়বে,” বেনারকে বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) দেবাশীষ বর্ধন।

ভবনের নিচতলায় অবস্থিতি খাবারের দোকান ‘শর্মা হাউজ’ অথবা মাংসের দোকান ‘বেঙ্গল মিট’ থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে জানান তিনি।

“আমার জীবনে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ কখনও শুনিনি, এটা বলে বোঝাতে পারব না,” বেনারকে বলেন রাখি নীড় ভবনের সংলগ্ন ‘মগবাজার প্লাজায়’ অবস্থিত সিদ্দিক টেইলার্সের সত্ত্বাধিকারী সিদ্দিক মণ্ডল। 

“সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটের দিকে এই বিস্ফোরণ ঘটে। বিকট শব্দে বিস্ফোরণে মুহূর্তেই কেঁপে ওঠে ওয়্যারলেস গেট এলাকার মূল সড়ক ও তার আশপাশ। রাস্তায় বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে কাচের টুকরা,” বেনারকে বলেন রাখি নীড় ভবন সংলগ্ন ‘হেয়ার ক্রাফট সেলুনে’র মালিক অমল চন্দ্র শীল সাগর।

রাখি নীড় ভবনটি মগবাজার ফ্লাইওভারের শেষ পয়েন্টে ৭৯ নং আউটার সার্কুলার রোডে অবস্থিত। রাস্তার অপর পাশে আড়ংয়ের শো রুম। বিস্ফোরণে সেই বহুতল ভবনটির প্রায় সব কাচ ঝরে পড়েছে। 

সোমবার বেনার প্রতিবেদক ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান রাস্তাজুড়ে বিছিয়ে আছে কাচের টুকরো। রাস্তার ওপর লাব্বাইক পরিবহন, আজমেরী পরিবহন ও আল মক্কা পরিবহনের তিনটি বাস কঙ্কালসার অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। এসব বাসের সিটের নিচে ও রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। 

রাখি নীড় ভবনটির নিচে পুরোটাই যেন ধ্বংসস্তূপ। ভবনের কয়েকটি কলাম আধভাঙ্গা হয়ে আছে। সামনে পড়ে আছে বিশাল একটি জেনারেটর। ধ্বসে পড়েছে সিঁড়ি ও নিচতলার ছাদের অংশবিশেষ। প্রায় বিধ্বস্ত হয়েছে পাশের তিনটি ভবন। 

বিস্ফোরণে ভবনটিতে আগুন লাগেনি। তবে নিচতলায় থাকা গ্র্যান্ড কনফেকশনারি, ক্যাফে শর্মা হাউজ ও মাংসের দোকান প্রায় মাটিতে মিশে গেছে। লোহার গ্রিল, আসবাবপত্র, ভবনের বিভিন্ন অংশ ছিটকে এসেছে রাস্তায়।

ভবনের দোতলায় ছিল সিঙ্গারের শো রুম এবং তিন তলায় ছিল ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের অফিস, যা এখন ধসে পড়ার অপেক্ষায়। 

ঘটনার পর থেকে সবার মনে একটি প্রশ্ন—এত বিকট শব্দে বিস্ফোরণের নেপথ্য কারণ কী? তবে সরকারের কোনো সংস্থাই এ বিষয়টি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেনি। জমাট গ্যাসের কারণে এই বিস্ফোরণ হতে পারে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশও একই ধারণার কথা বলেছে।

কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিস্ফোরক বিস্ফোরক পরিদপ্তর এবং তিতাস গ্যাস লিমিটেড আলাদা আলাদা কমিটি করেছে। 

জঙ্গিদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ

বিস্ফোরণস্থলটি দেখার পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “ভবনের নিচে মিথেন গ্যাসের গন্ধ আছে। গ্যাস সিলিন্ডারগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করার ফলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তবে পুরো তদন্তের আগে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে না।”

“আমরা পুলিশের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি করব। তদন্ত দল এই ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজতে ফায়ার সার্ভিসের সাথে কাজ করবে,” বলেন তিনি।

বিস্ফোরণের সঙ্গে জঙ্গিদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, “বোমা হামলা মনে করে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করা হবে। পুলিশের বোম ডিসপোজাল ইউনিটসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হবে।”

“বিস্ফোরণে একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। এটা যদি বিস্ফোরক হতো, তাহলে বহু দিকে, মানে, তিন চার দিকে যেত। আর এই ঘটনার পর গ্লাসের ভাঙা টুকরা ছাড়া আমরা অন্য কিছু খুঁজে পাইনি,” বলেন তিনি।

এর আগে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলামও বিস্ফোরণের পেছনে জঙ্গিদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করেছিলেন।

“ভবনের নিচতলায় হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি উপাদান,” বলে বেনারকে জানান বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ।

তবে তাঁর মতে, “কেবলমাত্র গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনাও অস্বাভাবিক।”

“আসল কারণ তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে,” বলেন আবুল কালাম আজাদ।

তবে ভবনটির দুপাশে থাকা বিল্ডিংগুলোতে “তিতাসের কোনো গ্যাস সংযোগ নেই,” জানিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত তিতাস গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, “আমাদের তদন্ত দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এলপিজি সিলিন্ডার পেয়েছেন।” 

স্থানীয় অনেকেই বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ থেকে এমনটি ঘটেছে বলে অনুমান করলেও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সংস্থার (ডিপিডিসি) কর্মকর্তারা এমন সম্ভাবনা নাকচ করেছেন।

“দুর্ঘটনার পর আমাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নিশ্চিত হন যে, বৈদ্যুতিক সংযোগে ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটেনি,” সাংবাদিকদের জানান ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান। 

Mogbazar2.JPG
বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত রাজধানীর মগবাজারে বাণিজ্যিক দালান ‘রাখি নীড়’ এর ধ্বংসাবশেষ থেকে তদন্তের জন্য আলামত সংগ্রহ করছেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা। ২৮ জুন ২০২১। [বেনারনিউজ]

হতাহত অনেক

সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে রোববার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, “এ পর্যন্ত সাতজন মারা গেছেন। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৫০ জন আহত হওয়ার তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে।” 

তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আহত প্রায় দুইশ মানুষকে ওই এলাকার রাশমনো হাসপাতাল, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আদ-দ্বীন মহিলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।

ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের নার্স মোমেনা আবেদীন বেনারকে বলেছেন, “আমরা এখানে শতাধিক আহত ব্যক্তির চিকিৎসা করেছি।”

গুরুতর আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে ঘটনাস্থলে কর্মরত পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। 

বিস্ফোরণে দগ্ধ পাঁচজন বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, “চিকিৎসাধীন পাঁচ জনের মধ্যে তিনজনের শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ।” 

নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে জান্নাত (২৩) নামে এক নারী ও তাঁর নয় মাসের শিশুসন্তান সোহানা। রাতে স্বপন নামে আরেকজন বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। সেখানে আরো দুজনের মৃত্যু হয়। তাঁদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।