বুড়িগঙ্গায় বড় লঞ্চের ধাক্কায় ডুবল ছোট লঞ্চ, ৩২ মরদেহ উদ্ধার

জেসমিন পাপড়ি
2020.06.29
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
200629_Buriganga_Launch_Capsize_1000.jpg বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবিতে এক স্বজনের নিহত হওয়ার সংবাদ ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ফোনে বাড়িতে জানাচ্ছেন এক নারী। ২৯ জুন ২০২০।
[নিউজরুম ফটো]

ঢাকার পোস্তগোলা সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে একটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় তুলনামূলক ছোট একটি লঞ্চ ডুবে অন্তত ৩২ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং লঞ্চডুবির সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনা নয়, এটাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে হচ্ছে।

ঘটনাস্থলের কাছের একটি সিসিটিভির ফুটেজ বেনার প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, মর্নিং বার্ড নামে আকারে ছোট লঞ্চটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে নিচ্ছে একটি বড় সাদা লঞ্চ (ময়ুর-২)। ছোট লঞ্চটি উল্টে বড় লঞ্চটির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

“ধাক্কা দেওয়া লঞ্চের চালককে গ্রেপ্তার করেছে নৌ-পুলিশ। আমরা ঘটনা অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব,” জানান নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী।

তবে সঠিক তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে নৌ পথে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

তিনি বেনারকে বলেন, “নৌপথে প্রতি বছর অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটলেও সেসব ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার হয় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবেই চালক কিংবা কর্মচারীদের অবহেলায় সড়কপথের মতো নৌপথেও দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে।”

এ প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার তদন্ত হয়, হয়তো সাংবাদিকরা নিয়মিত ফলো করেন না। অতীতে অনেকগুলো তদন্ত হয়েছে।

দমকল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা লিমা খানম বেনারকে জানান, “এখন পর্যন্ত ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।”

তিনি জানান, “নিহতদের মধ্যে ১৯ জন পুরুষ, ৮ নারী এবং তিনজন শিশু। বাকি দুইজনের বিষয়ে জানা যায়নি। উদ্ধার করা মরদেহগুলো মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।”

সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান লিমা খানম।

এরপর থেকেই দিনভর দমকল বাহিনীর পাশাপাশি নৌ বাহিনী, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখলেন

দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দেওয়া তথ্যমতে, মর্নিং বার্ড নামের ওই লঞ্চে ৫০-৬০ জন যাত্রী ছিলেন। তাঁদের কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও বেশিরভাগই ভেতরে আটকা পড়েন। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছেন সে তথ্য সোমবার রাত আটটা পর্যন্ত জানা যায়নি।

যাত্রীরা জানান, ঘাট থেকে মাত্র দুইশ হাত দূরে থাকতেই ডুবে যায় লঞ্চটি।

জীবিত উদ্ধার হওয়ার যাত্রী মো. মাসুদ ঘটনার বর্ণনা করে বেনারকে বলেন, “আমাদের লঞ্চটি তখন ঘাটের খুব কাছে। নামার জন্য আমরা তৈরি হচ্ছিলাম। ঘাটে ভেড়ানোর জন্য আমাদের লঞ্চটি সোজা চলছিল।”

“দেখলাম অন্য একটা লঞ্চ কিছুটা বাঁকাভাবে রওনা দিয়েছে। ওই লঞ্চটা আমাদের লঞ্চের মাঝ বরাবর ধাক্কা দেয়। সাথে সাথেই আমাদের লঞ্চটা কাত হয়ে ডুবে যায়। মাত্র ১০ সেকেন্ডও সময় লাগেনি ডুবতে,” বলেন তিনি।

মিটফোর্ট হাসপাতালে মাসুদ আহাজারি করছিলেন তাঁর সাথে থাকা দুই মামার জন্য।

তিনি বলেন, “নামার জন্য কেবিনের থেকে গ্লাস খুলে আমি বের হই। আমার আপন দুই মামা আফজাল শেখ ও বাচ্চু শেখ তখনো ভিতরে ছিলেন। আমি ভাগ্যক্রমে বাঁচলেও তাঁদের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরছি।”

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম সাংবাদিকদের জানান, ডুবে যাওয়া মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জ রুটের চলাচল করত। সোমবার সকালে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসার পথে শ্যামবাজারের কাছে এসে ময়ূর-২ নামে অপর একটি লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় সেটি।

সোমবার দিনভর সদরঘাটে ছিল স্বজনহারা মানুষের ভিড়। তাঁদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ।

ভগ্নিপতির খোঁজে বিলাপ করছিলেন নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম। তিনি বেনারকে বলেন, “আমার ভগ্নিপতি মনির হোসেন (৫০)। লঞ্চে করে তিনি ঢাকায় আসছিলেন। লঞ্চ ডুবির খবর শুনে ফোন করি। কিন্তু ফোন বন্ধ পাই। এখনো সন্ধান পাইনি।”

দুর্ঘটনার পরে সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের, ‘সিসিটিভির ফুটেজ দেখে লঞ্চডুবির এই ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে হচ্ছে। এটা যদি পরিকল্পিত হয় এবং সেটা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

লঞ্চডুবিতে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ। পাশাপাশি দাফন-কাফনের জন্য তাৎক্ষণিক ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা জানান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।