বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে দিনভর অবরোধ

জেসমিন পাপড়ি
2018.07.30
ঢাকা
180730_bus_accident_1000.JPG বাস চাপায় দুই ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকা বিমানবন্দর সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ৩০ জুলাই ২০১৮।
বেনারনিউজ

বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের দেওয়া বক্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়া শিক্ষার্থীরা সোমবার দিনভর বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় তারা বাস চালকের শাস্তি, নৌ পরিবহন মন্ত্রীর পদত্যাগসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরে।

শিক্ষার্থীরা রাজধানীর মিরপুর সড়ক, সাভারের ঢাকা–আরিচা মহাসড়কও অবরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে কিছু যানবাহন ভাঙচুর করে। সড়ক অবরোধের ফলে রাজধানীবাসীকে দিনভর মারাত্মক যানজটে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

রোববার দুই বাসের রেষারেষির সময় রাজধানীর কুর্মিটোলায় ফ্লাইওভারের ঢালে বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত ও আরও নয়জন আহত হন। তারা শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিমানবন্দর সড়কের বাঁ-পাশে তারা যখন বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এ ঘটনায় নিহতরা হলেন— দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম। আহতদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

মন্ত্রীর কথায় ক্ষোভ বেড়েছে

এদিন নৌমন্ত্রীর প্রশ্রয় ও মদদেই চালকেরা সড়কে এমন হত্যাকাণ্ড চালানোর সাহস পাচ্ছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা।

এ সময় শাজাহান খান, ভারতের মহারাষ্ট্রে একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে ৩৩ জন মারা যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে বলেন, “আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি এগুলো কি ওখানে ওভাবে বলে?”

দু’জন শিক্ষার্থীর এমন অকাল মৃত্যুর পরেও হাস্যোজ্জ্বল মন্ত্রীর মুখে এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা হতে থাকে। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবিও উঠে।

তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বেনারকে বলেন, “ঢাকা শহর পরিবহন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।”

তিনি বলেন, “সাধারণত কারিগরি ব্যক্তিরা এ সংক্রান্ত বিষয়ে গণপরিবহন পরিকল্পনা ও পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে আছে নন টেকনিক্যাল ও বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের প্রতিনিধি।”

ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক বাস পরিচালনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেটাই সমাধান আনতে পারে বলে মনে করেন এই প্রকৌশলী।

দিনভর অবরোধ, ভোগান্তি

সহপাঠী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিক থেকে রমিজউদ্দীন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর সড়কে জড়ো হতে শুরু করে। সকাল ১০টার দিকে কুর্মিটোলায় হোটেল র‍্যাডিসনের ওপাশে রোববারের দুর্ঘটনাস্থলে শ’খানেক শিক্ষার্থী জড়ো হন। এ সময় তাঁরা সড়ক অবরোধ করতে চাইলে পুলিশের বাঁধার মুখে পড়েন।

তবে এর আধা ঘণ্টার মধ্যেই রমিজউদ্দীন কলেজসহ আশপাশের অন্তত ১০টি স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা স্রোতের মতো রাস্তায় আসতে থাকে। এ সময় পুলিশ জল কামান, সাঁজোয়া যানসহ এক দফা ধাওয়া দিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে যানবাহন ভাঙচুর শুরু করে। এরপর পুলিশ সরে গিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়।

এরপর দিনভরই রাজধানীর এমইএস, জিয়া কলোনি চেকপোস্ট, শ্যাওড়া এলাকায় শিক্ষার্থীরা থেমে থেমে বিক্ষোভ করে। পুলিশ বনানী ও কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় যান চলাচল আটকে দেয়। এ সময় তারা দফায় দফায় ‘আমরা বিচার চাই’ (উই ওয়ান্ট জাস্টিস) স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শিক্ষার্থীরা ঘাতক চালকের ফাঁসি, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ, দুর্ঘটনাস্থলে স্পিডব্রেকার তৈরি, নিহতদের ক্ষতিপূরণসহ কয়েকটি দাবি করে।

এমন অবরোধের মুখে প্রয়োজনীয় কাজে বের হওয়া মানুষেরা বিশেষ করে বিদেশগামী, হজযাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। ভোগান্তিতে পড়তে হয় কুর্মিটোলাসহ আশপাশের হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীদেরও। তবে শিক্ষার্থীরা রোগী ও হজযাত্রীদের গাড়িগুলো অবরুদ্ধ এলাকা পার করে দেয়।

এই বিক্ষোভে রমিজউদ্দীন স্কুল ও কলেজ ছাড়াও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, শাহীন কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, নৌবাহিনী স্কুল, গুলশান কমার্স কলেজসহ মিরপুর, ভাসানটেক, তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়।

পুলিশ এবং রমিজউদ্দীন কলেজের শিক্ষকেরা দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। শেষমেশ বেলা ৪টার দিকে পুলিশ জলকামান, সাঁজোয়া যানসহ অবরোধকারীদের ধাওয়া দিয়ে খিলক্ষেতের দিকে গেলে শিক্ষার্থীরা ওই এলাকায় আটকে থাকা যানবাহনগুলোতে ভাঙচুর চালায়। বিকেল চারটার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

সমাধানে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি মন্ত্রী

এদিকে সমালোচনার মুখে দুর্ঘটনা সমস্যার সমাধানের জন্য মন্ত্রিত্ব ছাড়তেও রাজি থাকার কথা জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিক নেতা ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।

“দুর্ঘটনা ঘটলেই অনেকে আমার পদত্যাগ দাবি করেন। আপনারা যদি বলতে পারেন হ্যাঁ, আপনি গেলেই সব সমস্যা সমাধান হবে, আমার যেতে তো কোনো অসুবিধা নেই, সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলে তিনি।

তাঁর নেতৃত্বে দুর্ঘটনা হ্রাস পেয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

ক্ষতিপূরণের নির্দেশ

এদিকে এক সপ্তাহের মধ্যে নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। ঘাতক বাসটির মালিক জাবালে নূর পরিবহন কর্তৃপক্ষকে এই ক্ষতিপূরণ পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিহতদের পরিবার এ অর্থ পেল কিনা তা নিশ্চিত করে আগামী ১২ আগস্ট পরবর্তী শুনানির দিন বিআরটিএকে (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি) জানাতে বলা হয়েছে ।

পাশাপাশি জাবালে নূর পরিবহনকে দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করারও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সোমবার জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে রুলসহ এ আদেশ দেয় হাইকোর্টে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।