অবৈধ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.07.31
ঢাকা
180731_bus_accident_1000.jpeg বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকায় তৃতীয় দিনের মতো শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ। ৩০ জুলাই ২০১৮।
বেনারনিউজ

বাস চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকায় চলমান ছাত্র বিক্ষোভের তৃতীয় দিনে রাজধানীর গণপরিবহনের সকল অপ্রাপ্তবয়স্ক ড্রাইভার ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় অবৈধ চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয় বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এক প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক এস এম তরিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই প্রেস রিলিজে জানানো হয়,  সভায় গত রোববার গাড়িচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।

অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের শান্ত হয়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পরিবহন সেক্টরে ২৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এ সকল শ্রমিকদের অধিকাংশেরই বৈধ লাইসেন্স নাই। আবার অনেকের বয়স ১৫ বছরের নিচে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘনায় নিহত হয়।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, “ঢাকা শহরে মিনিবাস ও টেম্পো চালায় এমন ড্রাইভারদের অনেকেই ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন। টেম্পোতে বিরাট সংখ্যায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ড্রাইভার রয়েছে।”

“সরকার অবৈধ ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সেটি ঠিক আছে। হয়তো সমস্যার সাময়িক কিছুটা উন্নতি দেখা যেতে পারে। কিন্তু যারা অবৈধ ড্রাইভারদের নিয়োগ দেয় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না কেন? তারাও তো আইন ভঙ্গ করেছেন,” বলেন তিনি।

সুলতান উদ্দিন বলেন, “দ্বিতীয় বিষয় হলো ঢাকা শহরে যে সংখ্যক বাস, মিনিবাস, টেম্পো, থ্রি-হুইলার রয়েছে সেসংখ্যক ড্রাইভার নেই। আবার বৈধ উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া অসম্ভব। টাকা দিলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। বয়স কোনো ব্যাপার নয়।”

তিনি বলেন, “তৃতীয় বিষয় হলো: বাংলাদেশের শ্রম আইনে পরিবহন শ্রমিকদের যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই তারা পায় না। ঢাকা পৃথিবীর হয়তো একমাত্র শহর যেখানে পরিবহন শ্রমিকদের বিশ্রাম অথবা বিরতি দেওয়ার কোনো নগর টার্মিনাল নেই।”

তাঁর মতে, “একজন ড্রাইভার সকালে গাড়িতে ওঠার পর থেকে সে কোথাও বিরতি দিতে পারে না, বিশ্রাম নিতে পারে না। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতে পারে না। তাহলে আমরা তাদের কাছে কী আশা করব? তবে কোনোক্রমেই দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর ওপর গাড়ি তুলে দেওয়া সমর্থন করা যায় না।”

দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু

গত ২৯ জুলাই রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন।

শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক শাখার দ্বাদশ শ্রেণির আবদুল করিম এবং একাদশ শ্রেণির দিয়া খানম ওই ঘটনায় নিহত হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী জালাল আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা গাড়ির জন্য ফুটপাতে অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি মিনিবাস ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বাসটি তুলে দেয়।”

তিনি জানান, “ঘাতক জাবালে নূর পরিবহনের গাড়িটি আরেকটি গাড়ির সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর গাড়ি তুলে দেয়।”

গত রোববার দুর্ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খান হেসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। বিভিন্ন টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর সেই বক্তব্য প্রচারিত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা।

ঘটনার পরদিন সোমবার বিমানবন্দর, মিরপুরসহ ঢাকার অন্যান্য এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসে বাস ভাঙচুর করে।

ঢাকা অধিকাংশ পরিবহন কোম্পানিগুলো বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। যেসব বাস চলাচল করে তারা ভিন্ন রুট দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে। শিক্ষার্থীরা নৌ-মন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি তোলে।

মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের মতো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে ও গাড়ি ভাঙচুর করে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ শাজাহান খানের সমালোচনা করে বলেন, মৃত্যুর সংবাদে হেসে কথা বলা ঠিক নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই ছাত্র-ছাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে শাজাহান খানকে সংযতভাবে কথা বলার নির্দেশ দেন।

নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খান বেনারকে বলেন, জাবালে নূরের মালিকদের সবাইকে তিনি চেনেন না। তিনি দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখিত জানিয়ে বলেন, যারা দোষী তাদের শাস্তি পেতে হবে।

তিনি বলেন, যদি তাঁর কোনো বক্তব্যে জনগণ কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে তিনি দুঃখিত।

ড্রাইভার বাবা বিচার চান

রোববার নিহত ছাত্রী দিয়া খানমের বাবা একজন বাস ড্রাইভার। তিনি দায়ী ড্রাইভারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর গাড়ি চালানো দুর্ঘটনা নয়। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।”

র‌্যাব সোমবার জাবালে নূর পরিবহনের ওই দুই গাড়ির চালক সোহাগ আলী ও জুবায়ের এবং হেলপার এনায়েত হোসেন ও রিপনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

মঙ্গলবার আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।