ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চম দিনে বিচ্ছিন্ন ঢাকা

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.08.02
ঢাকা
180802_student_movement_1000.jpg বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদের পঞ্চম দিনে ঢাকায় শিক্ষার্থীরা বিজিবির গাড়ির চালকের লাইসেন্স না পেয়ে গাড়ির গায়ে তা লিখে রাখে। ২ আগস্ট ২০১৮।
বেনারনিউজ

বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারানো দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান ছাত্র বিক্ষোভের পঞ্চম দিন বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানী ঢাকা সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

“সমস্ত ঢাকা আজ অচল হয়ে গিয়েছিল। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি ঢাকায় ঢোকেনি বা ঢাকা থেকে বের হয়ে যায়নি। সিটি সার্ভিসের সমস্ত বাসও বন্ধ হয়ে গিয়েছে,” সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন।

নিরাপত্তার অভাবে গাড়ি বের না করার কথা বলেছেন বাস মালিক ও শ্রমিকেরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেন, “তাদের শঙ্কা যে কোনো সময় গাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হতে পারে।”

এরই মধ্যে বিকেলে মিরপুরে আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছে পুলিশ ও একদল দুর্বৃত্ত্ব। এ ঘটনার একাংশের লাইভ ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারকারী জেবা নূর বেনারকে বলেন, “আমাকেও মারা হয়েছে।”

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ বলছে, শিক্ষার্থীরা কোনো কারণ ছাড়াই কাফরুল থানায় হামলার চেষ্টা করে। তারা পুলিশের দিকে ইটপাটকেলও ছোড়ে।

তবে জেবা বেনারকে বলেন, “ওই সময় শিক্ষার্থীদের কেউ ‘মিস গাইড’ করেছে। সবাই শান্ত ছিল। অথচ কোথা থেকে ‘সিভিল’ বেশে কয়েকজন এসে একটা গাড়ি ভেঙে দিলো।”

পরে সেখানে পুলিশের সামনেই এক নারী আলোকচিত্রীকে মারধরে করে তাঁর ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। এ ঘটনার একাধিক ভিডিওচিত্রও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। শাহবাগ ও রাজারবাগেও আন্দোলনকারীদের মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

“এটা আস্তে আস্তে প্রতীয়মান হচ্ছে, এই আন্দোলন ভিন্ন দিকে বা একটা সহিংসতার দিকে টার্ন নিতে পারে, কিংবা একটা স্যাবোটাজ হতে পারে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“এর পেছনে একটি রাজনৈতিক অভিলাষ বা উদ্দেশ্য ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে আমরা মনে করি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ফেসবুকের ভিডিওতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছাত্রশিবিরের ও ছাত্রদলের নেতাদের দেখেছি। টেলিফোনে তাদের কথোপকথনও আমরা শুনেছি।”

“এরা যে কোনো সময় আমাদের কোমলমতি ছাত্রদের ‘মিস লিড’ করে তাদের দিয়ে একটা অপরাধ সংগঠিত করিয়ে দিতে পারে,” যোগ করেন তিনি।

এদিকে ঢাকার সকল স্কুল-কলেজ সরকারিভাবে বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মধ্যেই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ও নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবিতে তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে।

অনেক অভিভাবক বৃহস্পতিবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে রাস্তায় নেমে নিরাপদ সড়কের দাবিতে মিছিল করেন। তবে মন্ত্রী শাজাহান খান পদত্যাগ করবেন না বলে এই দিনও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

ঢাকায় শিক্ষার্থীরা মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিগত গাড়ি, সরকারি গাড়ি এবং পুলিশের গাড়ির কাগজপত্র ও চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে। এবং যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, মাগুরা, ফরিদপুর, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়াসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বলে খবর পাওয়া গেছে।

বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কোনো আন্দোলনে যাইনি। পরিস্থিতি শান্ত হলেই আমরা আবার গাড়ি চালাব। বর্তমানে যে অবস্থা তাতে গাড়ি চালানো বিপদজনক।”

এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন শ গাড়ি ভাঙচুর করা অথবা পোড়ানো হয়েছে, জানান তিনি।

গাবতলী বাস টার্মিনালে বাসের এক সুপারভাইজার মালেক বেনারকে বলেন, “সকাল থেকে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি গাবতলী থেকে ছেড়ে যায়নি।” মহাখালী বাস টার্মিনালের লাইনম্যান সাত্তার বলেন, “গাড়ি ছাড়ার মতো অবস্থা নাই।”

বেনারকে তিনি আরও বলেন, “ছাত্ররা ‘দেইখা-দেইখা’ বাস পোড়াইতাছে, ভাংতাছে। মালিকরা কি লাখ লাখ টাকার গাড়ি পোড়াইব? ঠান্ডা হোক। তহন চলব”।

ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য মহাখালী বাস টার্মিনালে এসেছিলেন রহিম মোল্লা (৬০)।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমার ভাই খুব অসুস্থ। আমার ময়মনসিংহ যাওয়া দরকার। কিন্তু কোনো গাড়ি চলছে না। আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার কোনো গাড়িও নাই। কী করব!”

শিক্ষালয় বন্ধেও দমেনি আন্দোলন

বৃহস্পতিবার সকল স্কুল কলেজ সরকারিভাবে বন্ধ রাখা হলেও ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তা থেকে সরে যায়নি।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকার উত্তরা, গুলশান, খিলক্ষেত, রামপুরা, ফার্মগেট, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়, মিরপুর ও নগরীর কমপক্ষে ২০টি পয়েন্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়।

“তারা উই ওয়ান্ট জাস্টিস” বলে স্লোগান দিতে থাকে।

গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষাকালে মন্ত্রী, বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে সরকারি কোনো গাড়ি তাদের হাত থেকে বাদ যায়নি।

যেসব গাড়ি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তাদের চলতে দেওয়া হয়নি। অনেককে সোপর্দ করা হয়েছে পুলিশের হাতে। ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় আইন লঙ্ঘনের দায়ে শত শত মামলা দায়ের করে পুলিশ।

শুধু শাহবাগ এলাকায় বৃহস্পতিবার এক’শ মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দুপুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট বায়জিদের ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে ছাত্রদের সাথে কথা বলেন। উত্তেজনার একপর্যায়ে তারা ওই সার্জেন্টকে মারধর করে তার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

তাপস নামক এক ছাত্র বেনারকে বলেন, “ছাত্ররা সার্জেন্টের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইলে তিনি তর্ক করতে থাকেন। তিনি বলেন, তোমরা কে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখার?”

“একপর্যায়ে তিনি ছাত্রদের হুমকি দিলে কিছু ছাত্র তাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। পরে ছাত্ররাই তাকে উদ্ধার করে পুলিশ বক্সে নিয়ে যায়।” তবে তার গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্ররা।

তাপস বলেন, “আমরা শহরে কোনো অবৈধ গাড়ি চলতে দেবো না। আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। আমরা অনিয়ম ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে।”

আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন

চলমান ছাত্র আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার দলীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করছি।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা এই ঘটনাবলি ও গত ঘটনার জন্য অবিলম্বে সরকারকে দায়ী করছি এবং তাদের পদত্যাগ দাবি করছি। আমরা শুধু নৌমন্ত্রী বা সেতুমন্ত্রীরই নয়, আমরা পুরো সরকারের পদত্যাগ দাবি করছি এ জন্য যে, তারা সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।”

জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপি কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এখন ছাত্র আন্দোলনের ওপর ভর করেছে।”

নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ

বাসের ধাক্কায় নিহত ছাত্র আব্দুল করিমের মা মহিমা বেগম ও মিমের বাবা জাহাঙ্গীর ফকির বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে বিচার দাবি করেন।

সাক্ষাৎ শেষে তারাও আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বলেন।

জাহাঙ্গীর ফকির সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা একটা শক্ত বিচার পাব আশা করি। এটা প্রধানমন্ত্রীর নিজের মুখের কথা।” করিমের মা মহিমা বলেন, “সবই হয়ে গেছে। এখন তোমরা যে যার ঘরে উঠে যাও।”

প্রধানমন্ত্রী পরিবার প্রতি ২০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র হস্তান্তর করেন বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর নামে বিকৃত, মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে জানিয়ে এসব অপসংবাদে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো গুজবে কান না দিতে আহ্বান জানান।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।