সড়ক দুর্ঘটনা: রত্নার এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন মিশে গেল মাটির সঙ্গে

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.08.07
ঢাকা
200807_Road_Accident_620.jpg সড়ক দুর্ঘটনায় পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্নার মৃত্যুতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি। ৭ আগস্ট ২০২০।
[বেনারনিউজ]

কেনিয়া ও লাদাখের প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচু পর্বতে আরোহন করেছিলেন রেশমা নাহার রত্না। ইচ্ছা ছিল ওয়াসফিয়া নাজনীনের মতো এভারেস্ট জয় করে সম্মানিত করবেন বাংলাদেশের নারী সমাজকে। সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন রত্মা (৩৩)।

“শুক্রবার সকালে ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের লেক সড়কে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার পথে কালো রংয়ের একটি মাইক্রোবাস তাঁকে চাপা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়,” বেনারকে জানান শেরে বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ।

“সিসি ক্যামেরা দেখে গাড়িটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হবে,” জানান তিনি।

আবুল কালাম আজাদ জানান, দ্রুত গতির মাইক্রোবাসের চাপায় দুমড়ে মুচড়ে যায় রত্মার সাইকেলটি। দুর্ঘটনার পর কিছু পথচারী দ্রুত তাঁকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনে চলে আসে সড়ক পরিবহন আইনের প্রসঙ্গটি, যেটি মালিক–শ্রমিকদের চাপের মুখে কার্যকর করছে না সরকার।

আইনটি গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটি কার্যকর হয়নি।

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল মতিন বেনারকে বলেন, “এভাবে প্রতিদিন একটি করে সম্ভাবনাময় প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, আর আমাদের তা নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সড়ক নিরাপত্তা আইন পাশ করল সরকার। এখন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ভয়ে সেই আইনটিও সরকার প্রয়োগ করতে পারছে না।”

“আমরা চাই অবিলম্বে সড়ক পরিবহন আইনটির প্রতিটি ধারা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হোক,” বলেন আব্দুল মতিন।

অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রেশমা নাহার রত্নার ছবির স্ক্রিন শট।
অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রেশমা নাহার রত্নার ছবির স্ক্রিন শট।
[বেনারনিউজ]

রত্মার মৃত্যুতে শোক

রত্মার মৃত্যুর খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গণিতের এই শিক্ষক তরুণ প্রজন্মের কাছে ছিলেন পরিচিত মুখ।

রত্মার বন্ধু রেজা ঘটক ফেসবুকে লিখেছেন, এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন দেখা রত্মার এই মৃত্যু মানতে পারছেন না। তিনি ঢাকায় আলাদা বাই সাইকেল লেন করার দাবি জানান।

শুক্রবার হাসপাতালে রত্মার দেবর মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডংয়ে উঠে পর্বত আরোহন শুরু করেন রত্মা। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্বতে আরোহন করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে কেনিয়ার লেনানা মাউন্ট, ভারতের লাদাখে অবস্থিত স্টক কানরি ও কাং ইয়াস্তে-২।

ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে ভারতের নেহেরু মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে পর্বতারোহনের প্রশিক্ষণ নেন রত্মা।

মনিরুজ্জামান বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতিবাচক নানা কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। বই পড়তেন, সদস্য ছিলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের। গান শুনতেন। বাই সাইকেল চালাতেন। বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন।

ঢাকার মিরপুর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন রত্না।

তাঁর মৃত্যুতে আবারও আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বাসের চাপায় প্রাণ হারান ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে সারাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা। আন্দোলকারীরা সাত দিন ঢাকাকে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

আন্দোলকারীদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সরকার ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে পাশ করে সড়ক পরিবহন আইন। এটি কার্যকর করার ঘোষণা এলে আন্দোলন শুরু করেন পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাঁদের বৈঠকে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়, এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত আইনটি প্রয়োগ বন্ধ রাখবে সরকার।

তবে করোনাভাইরাসের কারণে এখনো আইনটি কার্যকর করা হয়নি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “সড়ক আইনের ধারাগুলো প্রয়োগ করতে গেলে পুনরায় মালিক-শ্রমিকদের সাথে বৈঠক করতে হবে। তবে সরকার আইন যেহেতু করেছে সেটি বাস্তবায়ন করবে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য প্রয়োজন সকলের সহযোগিতা।”

সড়ক দুর্ঘটনা নিয় কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে সাত থেকে আট হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তবে সরকারি হিসেবে এই সংখ্যা কম।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক ডেটা বিশ্লেষক আবু বক্কর সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চার হাজার ১৩৮ জন মানুষ।”

এছাড়া ২০১৮ সালে দুই হাজার ৬৩৫জন ও ২০১৭ সালে দুই হাজার ৫১৩ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছের বলে জানান আবু বক্কর সিদ্দিক।

উল্লেখ্য, বিআরটিএ’র হিসেবে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা এখন ৪৪ লাখ ৭১ হাজার। কিন্তু যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স কম আছে ১২ লাখের মতো।

গত কয়েক মাস ধরে কিছু শর্ত শিথিল করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।