ট্রাফিক সপ্তাহের শেষ দিনেও প্রাণ গেল ১৮ জনের

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.08.14
ঢাকা
180814_Traffic_week_1000.JPG ট্রাফিক সপ্তাহ চলাকালে ঢাকায় এক মোটরসাইকেল চালকের কাগজপত্র পরীক্ষা করছে পুলিশ। ৯ আগস্ট ২০১৮।
বেনারনিউজ

সড়ক নিরাপদ করতে ও শৃঙ্খলা ফেরাতে দেশব্যাপী ১০-দিনের পুলিশি অভিযানের শেষ দিনে মঙ্গলবার সারা দেশে পাঁচ শিশুসহ কমপক্ষে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। আর এই ১০ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৭৩ জন।

ঢাকায় এক হাজার স্কাউটের সহায়তায় পুলিশ ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করলেও কমেনি যানজট, ফেরেনি শৃঙ্খলা। বরং, যানবাহনের অভাবে সারা দিন ও সন্ধ্যার পর বাসে উঠতে বা একটি বেবিট্যাক্সি ভাড়া করতে অনেককে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

তবে, কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, এই অভিযান পথচারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও আইন মানার প্রবণতা বৃদ্ধি করেছে।

পুলিশের হিসেবে, ট্রাফিক সপ্তাহের ১০ দিনে সারা দেশে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ২৪৯টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭ কোটি ৮ লাখ ১৪ হাজার ৩৭৫ টাকা। এ সময় ৭৪ হাজার ২২৪ জন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৫ হাজার ৪১৮টি যানবাহন।

মামলাগুলোর অধিকাংশ হয়েছে রাজধানীতে। জরিমানার তিন-চতুর্থাংশ আদায় হয়েছে রাজধানীতে। মামলা ও জরিমানার পাশাপাশি যানবাহনের চালক ও পথচারীদের উদ্দেশে প্রচার করা হয় সচেতনতামূলক বার্তা।

গত ১০ দিনে বিআরটিএ মামলা করেছে ৪৪৪টি। জরিমানা আদায় করেছে ৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৮৯ জন দালালকে। চালক, পথচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

নরসিংদীতে তিন শিশুসহ নিহত আট

মঙ্গলবার সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে নরসিংদী জেলায়। সকাল সাতটার দিকে জেলার শিবপুর থানার অন্তর্গত সোনামুড়ি টেক এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এক বিয়ের গাড়ির অপরদিক থেকে আসা একটি বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে তিন শিশুসহ আটজন নিহত হয়।

শিবপুর মডেল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বেনারকে জানান ওই দুর্ঘটনায় সজল (২০), স্নিগ্ধা (৮), প্রান্তিকা (৬) ও বৃষ্টিসহ (৭) আটজন নিহত হন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ওসি আজাদ জানান, নরসিংদীর রায়পুরায় এক বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে মাইক্রোবাসটি চাঁদপুরে যাচ্ছিল। ঢাকা থেকে সিলেটগামী মিতালি পরিবহনের একটি বাসের সামনের চাকা ফেটে গেলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। বাসটির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায় মাইক্রোবাসটি।

সাতক্ষীরায় ছাত্রী নিহত

আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার নাথ বেনারকে বলেন, বদরতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী তিথি স্বর্ণকার (১৩) তার ভাইয়ের সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাচ্ছিল। তার পাশ ‍দিয়ে একটি ট্রাক যাচ্ছিল।

তিনি বলেন, তিথির স্কুলব্যাগের এক অংশ ট্রাকের সঙ্গে লেগে সে ট্রাকের পেছনের চাকার নিচে পড়ে যায়। সে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় বলে জানান বিপ্লব কুমার। তবে তার ভাই অক্ষত আছে।

তিনি বলেন, ট্রাকের চালককে আটক করা হয়েছে।

নওগাঁয় যুবকের মৃত্যু

মহাদেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে আতিক (২২) নামক এক যুবক মারা গেছে। ঘটনাটি ঘটে মহাদেবপুর উপজেলার মগলেসপুর গ্রামে।

তিনি বলেন, নিহত আতিক মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিল। অপরদিক থেকে আসা একটি ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে ট্রাকের পেছনের চাকায় পড়ে সে মারা যায়।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, পিরোজপুর, কুমিল্লা, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও নওগাঁয় পৃথক দুর্ঘটনায় আরো আটজন প্রাণ হারায়।

ঢাকার ট্রাফিক অবস্থা

গত ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে রাস্তায় নেমে মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি ও ড্রাইভারদের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে থাকে।

এর মধ্যে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সড়কে মৃত্যু কমাতে পুলিশ ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করে। পরে সেটি ১০ দিন করা হয়।

পুলিশের সূত্র অনুযায়ী, গত ১০ দিনে সারা দেশে চলার অনুপযোগী গাড়ি ও চালকদের বিরুদ্ধে এক লাখের বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জরিমানা আদায় হয়েছে তিন কোটি টাকার বেশি।

তবে ফেরেনি শৃঙ্খলা বা যানজট কোনোটিই।

মিরপুর যাবার জন্য ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন ফজলুল হক।

তিনি বলেন, “ট্রাফিক সপ্তাহ শুরুর আগে দু-তিন মিনিট পর পর মিরপুরের গাড়ি পাওয়া যেত। এখন ৩০ মিনিট পর পর একটি গাড়ি আসছে। গাড়ি আসার সাথে সাথে শত শত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যাদের শরীরে জোর বেশি তারা উঠতে পারছে।”

ফজলুল হক বলেন, তিনি সোমবার দুঘন্টায় কোনো গাড়িতে উঠতে না পেরে ১৫ টাকা বাস ভাড়ার পথ ২০০ টাকা খরচ করে, চার দফায় রিকশা পরিবর্তন করে তিন ঘণ্টায় মিরপুর ১২ নম্বর পৌঁছেছেন।

মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাত অবধি শত শত যাত্রীকে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

বিকল্প পরিবহনের ড্রাইভার আলম বেনারকে বলেন, ট্রাফিক সপ্তাহ শুরুর পর কাগজপত্র না থাকা গাড়িগুলো আর রাস্তায় নামছে না। ফলে সড়কে গাড়ির সংখ্যা কম। কিন্তু যাত্রী কমেনি।

গাড়ি না থাকায় সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে রিকশা। তারা প্রায় সব সড়কে চলাচল করছে। বাড়ছে যানজট।

প্রজাপতি পরিবহনের হেলপার মানিক বেনারকে বলেন, “পুলিশ যখন একটি গাড়ি চেক করার জন্য দাঁড় করায় তখন সেই গাড়ির পেছনে থাকা শত শত গাড়ির গতি কমে যায়। এভাবে যানজট বাড়ছে।”

কাওরান বাজারে এক পুলিশ কর্মকর্তা কাওসার বেনারকে বলেন, পুলিশ সন্দেহজনক সকল গাড়ি ও তার ড্রাইভারের কাগজপত্র পরীক্ষা করছে।

তিনি বলেন, “ট্রাফিক সপ্তাহের ফলে মানুষের মধ্যে আইন মানার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি ধরে রাখতে হবে।”

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, “আগে আমি সুযোগ পেলে সময় বাঁচানোর জন্য রাস্তার মধ্যে দিয়ে পার হতাম। এখন অন্যান্যদের মতো আমিও ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করি। এভাবেই আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থায় একদিন শৃঙ্খলা ফিরবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।