গুজব ছড়ানোর অভিযোগে নারী উদ্যোক্তা গ্রেপ্তার

প্রাপ্তি রহমান
2018.08.17
ঢাকা
180817_More_arrested_story_620.jpg গুজব ছড়ানোর অভিযোগে নারী উদ্যোক্তা ফারিয়া মাহজাবীনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ১৭ আগস্ট ২০১৮।
সৌজন্যে: র‍্যাব

নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর-তরুণদের আন্দোলন গুজব ছড়িয়ে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে এবার গ্রেপ্তার হলেন একজন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে র‌্যাব-২ এর একটি দল তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

এই নিয়ে র‌্যাব গুজব ছড়ানোর দায়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করল।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতী মাহমুদ খান বেনারকে বলেছেন, যাঁরা গুজব রটিয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।

“যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁরা গুজব রটিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। একেবারে নিশ্চিত হয়েই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে,” মুফতী মাহমুদ খান বেনারনিউজকে বলেন।

তবে গুজব রটানো বা উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করছেন ভুক্তভোগী ও মানবাধিকার কর্মীরা।

শুক্রবার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে। বিকেলে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মোর্চা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানায়।

প্রসঙ্গত গত বুধবার ভোরে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বৃহস্পতিবার তাঁকে রমনা থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

ফারিয়া মাহজাবীন গ্রেপ্তার

ফারিয়া মাহজাবীন (২৮) নার্ডি বিন কফি হাউজ নামের একটি কফি হাউজ চালান। থাকেন পশ্চিম ধানমন্ডির হাজী আফসার উদ্দীন রোডের বাসায়।

সেখান থেকে র‌্যাব ২ এর একটি দল তাঁকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গ্রেপ্তার করে।

সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে র‌্যাব জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ফারিয়া মাহজাবীনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন সেট, ফেসবুক আইডি প্রোফাইলের প্রিন্ট কপি ও অডিও ক্লিপের প্রিন্ট কপি জব্দ করা হয়।

বিকেলে হাজারিবাগ থানার উপপরিদর্শক মাজেদুল ইসলাম তাঁকে আদালতে উপস্থাপন করে সাতদিনের রিমান্ড চান। আদালতে ফারিয়ার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। পরে মহানগর হাকিম একেএম মাইনুদ্দিন সিদ্দিকী তাঁর তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

হয়রানির অভিযোগ

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মোর্চা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ শুক্রবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে। পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউল্লাহ লুমার গ্রেপ্তারকে “মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত,” বলে মন্তব্য করেন।

“দেখুন, লুমা গত ৫ জুলাই ঢাকা ছেড়ে সিরাজগঞ্জ চলে যায়। সে আন্দোলনের সময় ঢাকায় ছিল না। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই নেই। অথচ তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমরা মনে করি একটি বিশেষ পক্ষকে খুশি করতে পুলিশ এই কাজ করেছে,” আতাউল্লাহ বলেন।

তিনি জানান, লুৎফুন্নাহার একটি গোলাপি রংয়ের ড্রেস পরে টিভির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। ৪ আগস্ট জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলার সময় প্রায় একই রকম একটি ড্রেস পরে একজন শিক্ষার্থী খুন ও ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে ভিডিও পোস্ট দেয়। তারপর থেকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা লুৎফুন্নাহারের বিরুদ্ধে গুজব রটাতে শুরু করে। এখন লুৎফুন্নাহারকে সে খেসারতই দিতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ অসত্য। লুৎফুন্নাহার উসকানিমূলক পোস্ট দিয়েছেন।

নাজমুল বলেন, তাঁরা শতাধিক আইডি শনাক্ত করেছেন। এসব আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হয়েছে।

মানববন্ধন থেকে মুক্তি দাবি

কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি দাবি করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকার কর্মীরা।

মানববন্ধনে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, হাতে দড়ি বেঁধে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সভ্য সমাজের লক্ষণ এটা নয়। তিনি বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

গতকাল মানববন্ধনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত তিন যুগ্ম আহ্বায়কের পরিবার ও বেসরকারি বিশ্বিবিদ্যালয়ের গ্রেপ্তারকৃত ১৩ ছাত্রের পরিবার অংশ নেয়। মানবনন্ধনে উপস্থিত ছিলেন শতাধিক মানুষ।

ক্র্যাক ডাউন বন্ধের আহ্বান অ্যামনেস্টির

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গতকাল এক বিবৃতিতে অবিলম্বে গ্রেপ্তার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি সাউথ এশিয়া ডিরেক্টর ওমর ওয়ারাইক বলেন, “ছাত্ররা ছিল সামগ্রিক অর্থেই শান্ত। খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিল। তাঁদের কারণে সুশীল সমাজের ওপর হামলা অগ্রহণযোগ্য। তাঁরা এখন মনে করছেন ভিন্নমতের কারণে তাঁরা শাস্তি পাবেন এবং গ্রেপ্তার হবেন।”

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বেনারনিউজকে বলেন, গ্রেপ্তার এই সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না।

“গুজব কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন ছড়িয়েছিল, সেটা সরকারের বিচেনায় নেওয়া উচিত। অবাধ তথ্য প্রবাহ থাকলে মানুষ গুজবে কান দিত না। জিগাতলায় ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। মূল ধারার গণমাধ্যম থেকে তথ্য না পাওয়ায় হাতের কাছে যে, যা তথ্য পেয়েছে তাই-ই শেয়ার করেছে,” নূর খান লিটন বলেন।

শহিদুল আলম গ্রেপ্তার: সরকারের সাফাই

এদিকে খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিজিআর পাবলিক রিলেশনস থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয় সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে চলমান আন্দোলনের সময় শহিদুল আলমের “তথ্যগত ভুল মন্তব্য আন্দোলনকে সহিংস করতে এক বড় ভূমিকা পালন করে।”

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে মর্মে শহিদুল আলম গুজব ছড়ান বলেও ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়। তবে বেনারের পক্ষ থেকে শহিদুল আলমের ৪ আগস্টের সবগুলো ফেসবুক পোস্ট পরীক্ষা করেও শিক্ষার্থীদের ধর্ষণ ও নিহত হওয়া সম্পর্কিত কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, ধানমন্ডি ৩ নম্বরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দুজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এবং চার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন একটি গুজব ৪ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। এরপর থেকেই আন্দোলনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

পর দিন ৫ আগস্ট আন্দোলন সম্পর্কে কাতারভিত্তি টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরায় এক সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম আন্দোলনকারীদের ওপর সরকার ও সরকারি দলের দমন পীড়নের সমালোচনা করেন। এরপর ওইদিন রাতেই তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ।

আন্দোলনে সহিংসতার জন্য বিএনপি ও জামায়াত, ‘ছাত্রদের ছদ্মবেশে’ আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকেদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলেও ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

তবে ‘শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক নির্যাতন এবং বিএনপির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা কেন?’ শিরোনামে ১০ আগস্ট ঢাকায় এক মত বিনিময় সভায় ঘটনাবলির জন্য সরকারকেই দায়ী করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।