গার্ডার ট্রাজেডি: চীনা কোম্পানি নিয়োজিত ক্রেন অপারেটরসহ গ্রেপ্তার ১০
2022.08.18
ঢাকা

চায়না গেজুয়া গ্রুপ কর্পোরেশনের (সিজিজিসি) মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার চাপা পড়ে পাঁচ ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বুধবার রাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
“ওই ঘটনার সময় ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী (হেলপার) রাকিব হোসেন। আর বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অপারেটর বা ক্রেনচালক আল আমিন,” সংবাদ সম্মেলনে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এদিকে গার্ডার দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে চীনের কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ.বি.এম আমিন উল্লাহ নূরীর সাথে সাক্ষাতে চীনা রাষ্ট্রদূত এমন মত দেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
সাক্ষাতে চীনা রাষ্ট্রদূত উত্তরায় ঢাকা বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
গত সোমবার (১৫ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দীন রোডে বিআরটি প্রকল্পের ক্রেনে থাকা গার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয় এবং দুজন আহত হন।
এই ঘটনায় ক্রেন পরিচালনা করা চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়ী করে ওই দিনই উত্তরা পশ্চিম থানায় নিহত ঝরনা আক্তারের ভাই মো. আফরান মণ্ডল বাদী হয়ে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন।
ঢাকায় চীনা প্রতিনিধি দল
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে চীনা রাষ্ট্রদূত জানান, ঢাকা বিআরটি প্রকল্পের সওজ অংশের নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তদন্তের জন্য চীন থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে।
প্রতিনিধি দলটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত বলেও জানান লি জিমিং।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, “এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সমগ্র জাতি ব্যথিত।”
যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিতে আমরা বুয়েটের একজন বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত, নিরাপত্তা বিধান করতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা বেনারের এমন প্রশ্নের জবাবে নূরী বলেন, “ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে ব্যর্থতার কারণ জানতে চেয়ে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছে। কেউই ছাড় পাবেন না।”
ক্রেনটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ
গ্রেপ্তারদের বিষয় বিস্তারিত জানাতে বৃহস্পতিবার একটি সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব। সেখানে মঈন জানান, বিআরটি প্রকল্পের যে ক্রেন থেকে প্রাইভেট কারের ওপর গার্ডার পড়েছে সেটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ক্রেন যে গার্ডারটি তুলছিল সেটির ওজন ছিল ৬০-৭০ টন।
“থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। ক্রেনটি আনুমানিক ১৯৯৬-৯৭ সালে আনা হয়েছিল। প্রথমে ক্রেনটির সক্ষমতা ৮০ টন ছিল। পরে আস্তে আস্তে ক্রেনটির সক্ষমতা কমে যায়। সর্বশেষ ক্রেনটির সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। এছাড়া ২০২১ সালে সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়, এরপর ক্রেনটির আর ফিটনেস যাচাই করা হয়নি,” বলেন এই র্যাব কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব জানতে পেরেছে, ফিটনেস না থাকা ক্রেনটি অতিরিক্ত ভার বহন করায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।”
গ্রেপ্তার হয়েছেন যারা
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, “বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুয়া গ্রুপের তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রজেক্টের গার্ডার উত্তোলনের কাজ চলাকালে এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এজন্য এর চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
“ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন আজহারুল ইসলাম মিঠু। তাঁদের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার এই পরিচালক বলেন, “ইফকনের কাছে বড়ো ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়া প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার কারণে এবং হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
মঈন বলেন, “ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর দুই-তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেন। এরপর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার সহকারী রাকিব তিন মাস আগে এই প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার ক্রেন চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না।”
“দুর্ঘটনার দিন আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালানো শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলন করতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গার্ডারটি রাস্তায় চলমান প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। দুর্ঘটনার সময় হেলপার রাকিব ক্রেন চালাচ্ছিলেন এবং ক্রেন অপারেটর আল আমিন বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান,” বলেন মঈন।
ওই স্থানে দায়িত্বে থাকা চীনা কর্মকর্তাদের কাউকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি— এমন প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, “একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসবে এ ঘটনায় দায়ী কারা। এছাড়া ওই ঘটনায় প্রাথমিকভাবে যাদের দায় রয়েছে বা জড়িত রয়েছে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
এ ধরনের ঘটনা ঘটার আগেই কেন সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না— এমন প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, “এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে কাজ করা উচিত। সেই কাজটি তারা করেনি। তাছাড়া এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও সংখ্যা ছিল খুব কম।”