বাংলাদেশে নৌ দুর্ঘটনাগুলোর বিচার হয় নামকাওয়াস্তে
2021.12.28
ঢাকা
প্রতি বছর বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লঞ্চ দুর্ঘটনায় কয়েকশ প্রাণহানিসহ বিপুল সম্পদ নষ্ট হলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নৌ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ১৭২টি মামলা দায়ের করা হলেও মাত্র আটটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, বাকিগুলো চলমান থাকলেও কবে নাগাদ শেষ হবে তা সংশ্লিষ্টরাও জানেন না।
সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী ও বর্তমান নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “নৌ-দুর্ঘটনার পর নৌ আদালতে মামলা হয়। দেশে একটি নৌ আদালতে বিচারকের সংখ্যা একজন। ফলে বিচারিক কাজ সঠিকভাবে হয় না।”
“কয়েক বছর আগে আমি মন্ত্রী থাকাকালে চারটি নৌ আদালত স্থাপনের জন্য প্রস্তাবনা পাঠালেও তা আজও গঠন করা হয়নি,” যোগ করেন তিনি।
শাজাহান খান বলেন, “প্রায় সব দুর্ঘটনার মামলায় সাক্ষী হাজির হয় না বা সাক্ষী পাওয়া যায় না। এসব কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনার বিচার করাও সম্ভব হয় না।
যদিও বিচার না হওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং সরকারি দপ্তরগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্নীতিকে দায়ী করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
নৌ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলায় সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর এবং জরিমানা। গত ১২ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া আট মামলার মধ্যে ২০১০ সালে তিনটি মামলায় আসামিদের জেল-জরিমানা হয়। ২০১১ সালে একটি মামলায় সাজা হয়, আরেকটিতে আসামিরা খালাস পায়। ২০১২ সালে একটিতে জেল, অপরটিতে খালাস দেয় আদালত। ২০১৬ সালে একটি মামলায় খালাস পায় আসামিরা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। এরই মধ্যে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে যায় এবং আগের দুর্ঘটনাটি যতো ভয়াবহ হোক না কেন সেগুলো কেউ মনে রাখে না, এটাই রূঢ় বাস্তবতা।”
তিনি বলেন, “লঞ্চ মালিকেরা বিত্তবান। তারা টাকা পয়সা দিয়ে সব কিছু ম্যানেজ করেন। সরকারি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা ভালো করেই জানেন তাঁরা কোন লঞ্চ যদি চলাচলের অনুপযোগী বলে প্রতিবেদন দাখিল করেন, তাতে ওই লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয় না।”
অধ্যাপক মিজান বলেন, “ফলে এভাবে মানুষ মরতেই থাকে। কিন্তু বিচার হয় না, হলেও তা নামকাওয়াস্তে। ফলে দুর্ঘটনাও থামে না।”
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্মসচিব দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রতিটি লঞ্চ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা হয়। আর সেকারণেই আপনারা দেখবেন, প্রতি বছরই লঞ্চ দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে এসেছে।”
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বর্তমানে ঢাকার নৌ আদালতে একজন বিচারক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাই লঞ্চ দুর্ঘটনার মামলাগুলো ইচ্ছা করলেও দ্রুত সম্পন্ন করা যায় না। নৌ আদালত ইচ্ছা করলেই সাক্ষী হাজির করতে পারে না। দেশের অন্যান্য আদালতে যেমন মামলাজট রয়েছে, এখানেও অবস্থাটা তেমনই।”
বেল্লাল হোসেন বলেন, “ঢাকার পাশাপাশি বরিশালে একটি নৌ আদালত স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেই যে বিচার ত্বরান্বিত হবে সেটি বলা কঠিন।”
মৃত্যু ৪৪, নিখোঁজ ৩০
গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনামুখী লঞ্চ অভিযান-১০ ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মুখে পড়ে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক জোহর আলী মঙ্গলবার রাতে বেনারকে বলেন, এই দুর্ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৪ যাত্রী নিহত হয়েছেন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৩০ জন।
উদ্ধার অভিযান চলমান রয়েছে বলেও তিনি জানান।
এই দুর্ঘটনার দায়ে লঞ্চের মালিক ও লঞ্চ চালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং দমকল বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
সোমবার লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখকে আটক করে র্যাব। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া মঙ্গলবার নৌ-আদালতে আত্নসমর্পন করেন লঞ্চের দুই মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার এবং মো. খলিলুর রহমান।
আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন মঙ্গলবার বেনারকে জানান, আদালত ওই দুই মাস্টারকে কারাগারে প্রেরণ করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
নারায়ণগঞ্জের বিষনন্দি ইসলামীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি লোকমান হোসেন তার আট ছাত্রকে নিয়ে বরগুনার পাথরঘাটায় যাচ্ছিলেন।
অভিযান-১০ অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিসাধীন লোকমান বেনারকে বলেন, “লঞ্চ যখন সদরঘাটে তখনই লঞ্চে একটি বিকট শব্দ হয়। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এবং যাত্রীরা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি।”
তিনি বলেন, “লঞ্চটি বরিশাল পর্যন্ত আসলে শব্দ আরো বেড়ে যায়। লঞ্চটিতে যখন আগুন লাগে তখনো লঞ্চ ঘাটে না ভিড়িয়ে চলতেই থাকে।”
তিনি জানান, “আমরা জাহাজ থেকে লাফিয়ে বাঁচতে পারলেও আট ছাত্রের মধ্যে শিশু মো. রাকিব হোসেনকে বাঁচাতে পারিনি।“
দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু
দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু সংক্রান্ত নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদন বেনারের হাতে এসেছে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে ১৫০টি নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ৩৪৭ জন এবং নিখোঁজ ছিল আরও ১৭৮ জন।
পরবর্তী দশকে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট ৩১৫টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭০১ জনের প্রাণহানি হয় এবং নিখোঁজ হয় ১৩৯ জন।
২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪৩টি নৌ দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৫৮৪ জন এবং নিখোঁজ ছিল আরও ১০২ জন।
চলতি ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৯টি নৌ দুর্ঘটনার তথ্য থাকলেও নিহত ও নিখোঁজের তথ্য পাওয়া যায়নি অধিদপ্তরের কাছে।
অপেক্ষা তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক ও সদরঘাট টার্মিনালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ জয়নাল আবেদীন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে নৌ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ঝড়, কুয়াশা ও প্রতিকূল আবহাওয়া। সেকারণে আমরা ঝড় শুরু হওয়ার আগেই লঞ্চগুলো আটকে রাখি। কুয়াশার ব্যাপারেও চালকদের সতর্ক করা হয়। বেশি যাত্রী যাতে না নেওয়া হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু এবারের দুর্ঘটনা ভিন্ন কারণে।”
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্মসচিব (অপারেশন) মোঃ দেলোয়ার হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা না দেয়া পর্যন্ত আমরা দুর্ঘটনার কারণ বলতে পারছি না।”
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বেনারকে বলেন, “আমরা উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এর কারণ অনেক সময় দেখা যায় দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরও লাশ ভেসে ওঠে।”
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ইঞ্জিনরুম থেকে। তদন্ত কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।”
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে ঘন ঘন নৌ দুর্ঘটনার কারণ হলো আমাদের জাহাজ নির্মাণ বিধি, এটি ২০০১ সালে প্রস্তুত। তখন এতো বড় জাহাজ নির্মাণ হতো না। তাই এই বিধি সময়োপযোগী করা দরকার।“
সৈয়দ আরিফুল হক বলেন, “জাহাজ নির্মাণের মান নির্ধারণের জন্য বিশ্বে আন্তর্জাতিক ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই সোসাইটির কার্যক্রম নেই।”
সৈয়দ আরিফুল বলেন, বাংলাদেশে প্রায় শতকরা ৪৩ ভাগ নৌ দুর্ঘটনা হয় মুখোমুখি সংঘর্ষে। এর পরে রয়েছে অতিরিক্ত যাত্রী বহন (প্রায় ২৫ ভাগ)। ঝড়, সাইক্লোন ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ২৩ শতাংশ দুর্ঘটনা হয়। অগ্নিকাণ্ডের কারণে নৌ দুর্ঘটনা ঘটে শতকরা প্রায় ছয় ভাগ।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নদী পথের ওপর নির্ভরশীল। দেশে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বিভিন্ন ধরনের জলযান রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার যাত্রীবাহী লঞ্চ।