কন্যা সাহসিকা: পৃথুলা রশিদ

শরীফ খিয়াম
2018.03.16
ঢাকা
পৃথুলার শৈশবের ছবি দেখে সান্ত্বনা খুঁজছেন স্বজনেরা। পৃথুলার শৈশবের ছবি দেখে সান্ত্বনা খুঁজছেন স্বজনেরা। ১৪ মার্চ ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

আকাশ পরিবহনে বাংলাদেশের অতি অল্প নারীদের একজন পৃথুলা রশিদ নিজের আগ্রহেই বেছে নিয়েছিলেন বৈমানিকের পেশা। আর সেই পেশাগত দায়িত্ব পালনকালেই গত সোমবার কাঠমান্ডুর ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন বাবা-মায়ের এই একমাত্র সন্তান।

“বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তার পাইলট হওয়ার ইচ্ছে জাগে। প্রথম দিকে বাবা-মা বা পরিবারের অন্য কেউ তার এই ঝুঁকিপূর্ণ আগ্রহ মেনে নিতে চায়নি,” বেনারকে বলেন পৃথুলার খালু তৌফিকুর রহমান সুমন।

“কিন্তু পরে তার ইচ্ছারই জয় হয়,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “তা ছাড়া আমরা জানতাম, সে যা করবে তা খুব ভালোই করবে।”

সাহিত্য আর পোষা প্রাণিদের জন্য টান ছাড়া নিজের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর নিজের মূল্যায়ন ‘এক সাধারণ মেয়ে’ হলেও সব সময়ই অন্যদের জন্য পৃথুলা ‘কিছু করার চেষ্টা’ করতেন বলে জানিয়েছেন ঘনিষ্ঠরা।

“পৃথুলা খুব শান্তশিষ্ট ছিল। ওর দ্বারা কখনো কারও কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছে,” বলেন তাঁর মামা আশিকুর রহমান।

“আসলে ও কোনো সাধারণ মেয়ে ছিল না,” এক বাক্যেই বেনারের কাছে পৃথুলাকে বর্ণনা করেন সন্তানহারা পিতা আনিসুর রশিদ।

বিস্তারিত জানতে চাইলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেওয়া আনিসুর রশিদ বলেন, “ওর ব্যাপারে এখন আর কী বলব আমি! ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আর কিছুই বলার নেই।”

তবে পৃথুলার মামা আশিকুর রহমান বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি মৃত্যুর আগেও সে নিজের জীবন দিয়ে অন্যকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।”

“শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে অন্যদের রক্ষা করেছে, নিজেও নিহত হয়েছে,” বলেন পৃথুলার বাবা।

এদিকে বিধ্বস্ত বিমানে পৃথুলার বুদ্ধিমত্তার কারণে কমপক্ষে ১০জন যাত্রী প্রাণে বেঁচে যান জানিয়ে ভারতীয় একটি ফেসবুক গ্রুপ ‘সিকিম মেসেঞ্জার’ তাঁকে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ নামে আখ্যায়িত করে।

বেনারনিউজের পক্ষ থেকে সিকিম মেসেঞ্জারের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের সংবাদের তথ্যসূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও গত কয়েকদিন ধরে সিকিম মেসেঞ্জারের এই বার্তাটি নিয়ে আলোচনায় মুখর ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

চেনা অচেনা বহু মানুষের ভালোবাসা আর সান্ত্বনায় ভরে উঠেছে পৃথুলার ফেসবুক পেজ।

“ভালোবাসি তোমাকে প্রিথুলা রশিদ, বোন আমার। তোমাদের মতো কিছু কিছু মানুষের জন্যই বাংলাদেশের নামটা আরেকটু উঁচুতে ওঠে। ভালো থেকো পরপারে,” নিজের ফেসবুক পেজে গত মঙ্গলবার লেখেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

“তোমার পরিবার তোমার জন্য নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে অনেক, তাঁরা তোমাকে নিয়ে গর্বও করবেন,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।

ফেসবুকে পৃথুলার শেষ পোস্টটি ছিল ‘আলভেড’ নামের একটি বিড়ালের সঙ্গে তোলা অনেকগুলো ছবি।

এদিকে বিমান দুর্ঘটনার পরপরই কিছু রক্ষণশীল বাংলাদেশি পুরুষ ফেসবুকে নারীদের বিমান চালানোর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এ প্রসঙ্গে পৃথুলার এক আত্মীয় বলেন “কিছু মানুষ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। আমাদের মেয়েকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা নেতিবাচক কথাবার্তা বলা হচ্ছে, যা আদৌ ঠিক না।”

ইউএস বাংলা বিমানের সামনে কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ।
ইউএস বাংলা বিমানের সামনে কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ।
সূত্র: পৃথুলার ফেসবুক

গুটিকয় নারী বৈমানিকের একজন

গত সোমবার কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত ইউএস বাংলা বিমানের কো-পাইলট এবং প্রথম নারী বৈমানিক ছিলেন পৃথুলা।

“বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান পৃথুলার জন্ম ১৯৯২ সালের ১৮ জুলাই, ঢাকাতেই। ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের প্রথম নারী পাইলট তিনি,” বেনারকে বলেন পৃথুলার মামা আশিকুর রহমান।

তিনি জানান, পৃথুলা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসে পাইলট/ফার্স্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন ২০১৬ সালের জুলাইতে। তিনি প্রশিক্ষণ নেন আরিরাং ফ্লাইং স্কুল থেকে।

আরিরাং এর আইটি অফিসার এসএম শাহাদৎ হোসেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোকে জানান, ‘পৃথুলা আরিরাং এর তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী ছিল, ২০১২ সালে। সে দুই বছরের কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স কোর্স শেষ করেছিল।”

বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থার পাইলটেরা বেনারকে জানান, বাংলাদেশের তিনটি বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থায় কমপক্ষে আড়াই শ বৈমানিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারী ১৫ জনের বেশি নন।

আর সরকারি সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এক কর্মকর্তা জানান, তাঁদের ১৯৩ জন পাইলটের মধ্যে নারী আছেন বড়জোর ১০ জন।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) পরিচালক (এফএসআর) উইং কমান্ডার চৌধুরী মো. জিয়াউল কবির বেনারকে বলেন, “এখন অবধি ১২শ পাইলটকে লাইসেন্স দিয়েছে বেবিচক। যার মধ্যে সক্রিয় আছেন প্রায় ৬৫০ জন। তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ জন নারী পাইলট।”

“অতীতের তুলনায় নারী পাইলটের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে,” উল্লেখ করেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই কর্মকর্তা।

ছাত্র জীবনে পৃথুলা রশিদ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের “ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ অ্যান্ড মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজে’ এর শিক্ষার্থী ছিলেন বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অফিশিয়াল পেজ।

“পৃথুলা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের গর্ব,” বেনারকে বলেন পৃথুলার একজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মী।

ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ তাদের দুজন বৈমানিক ও দুজন ক্রু এর মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিকভাবে গভীর শোক প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা

অ্যাভিয়েশন সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউএস বাংলার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এতে বৈমানিকসহ মোট ৫১ জন আরোহী নিহত হন।

দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান মঙ্গলবার কাঠমান্ডুর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

এর আগে ১৯৮৪ সালে ঢাকায় একটি বিমান দুর্ঘটনায় ৪৯ জন আরোহী প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে বেনারকে জানান রিজেন্ট এয়ারলাইনসের এক বৈমানিক।

দুর্ঘটনার কারণ এখনো অজানা

কাঠমান্ডুতে ইউএস বাংলার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঠিক কারণ এখনো অজানা।

ত্রিভুবনের কর্মীরা সাংবাদিকদের জানান বিমানটি রানওয়ের ১৫০ ফুট দূরে বিমানবন্দরের সীমানার বাইরে একটি মাঠে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। সাথে সাথেই বিমানের পেছন দিকে আগুন লেগে যায়।

উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিমানের সামনের দিকে থাকা যাত্রীদের টেনে বের করেন।

মঙ্গলবার নেপালের সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ জানায়, ফ্লাইট বিএস ২১১ কে বিমানবন্দরের একমাত্র রানওয়ের দক্ষিণ দিক থেকে অবতরণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিমানটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিপরীত দিক থেকে অবতরণ করে। বিমানটির গতিপথ সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হলেও তা মানেননি বৈমানিকরা।

তবে কাঠমান্ডু বিমানবন্দর কন্ট্রোল রুমের ভুল নির্দেশনার কারণেই বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল বলে এর আগে অভিযোগ করেছিলেন ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিমানের ব্ল্যাক বক্স বা ডাটা রেকর্ডার; যেখানে ককপিটের কথোপকথনসহ ফ্লাইটের সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে, সেটি মঙ্গলবার উদ্ধার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তদন্তকারীরা আশা করছেন ব্ল্যাক বক্সের তথ্য পর্যালোচনা করলেই দুর্ঘটনার মূল কারণ পরিষ্কার হবে। দুর্ঘটনা তদন্তেও এটি সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

‘সব নিয়ে চলে গেছে পৃথুলা’

“নেপালে যাওয়ার আগে বিমানবন্দর থেকে পৃথুলা তার মা-কে ফোন করেছিল,” বেনারকে বলেন পৃথুলার খালু তৌফিকুর রহমান সুমন।

বুধবার মিরপুর ডিওএইচএস এ পৃথুলার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পৃথুলার শোকাতুর মা রাফেজা খাতুনকে একটু কিছু খাওয়াতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন আত্মীয় স্বজনরা।

“পৃথুলা নেই শোনার পর থেকে কিচ্ছু মুখে দেননি তিনি, শুধু কেঁদেই চলেছেন। কতবার যে জ্ঞান হারিয়েছেন তার আর ইয়ত্তা নেই,” বেনারকে বলেন পৃথুলার এক স্বজন।

পৃথুলার মা রাফেজা দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বেনার প্রতিবেদকের সামনেই তিনি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন, “আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকব? আমার তো সব শেষ।”

পৃথুলার বাবা আনিসুর রশিদ বলেন, “পৃথুলা আমাদের সব নিয়ে চলে গেছে।”

তিনি বলেন, “অনেক বন্ধু, স্বজন ফোন করছেন। তাঁরা পৃথুলার খেতাব অর্জনের কথাও বলছেন। আমি তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন করছি, আমরা এই অর্জন দিয়ে কী করব এখন?”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।