মারা গেলেন যৌন হয়রানির প্রতিবাদে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত

প্রাপ্তি রহমান
2019.04.10
ঢাকা
190410_BD_Nusrat_1000.jpg মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুসরাতের বাবা একেএম মুসা। ১০ এপ্রিল ২০১৯।
[ফোকাস বাংলা]

টানা চারদিনের বেশি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মারা গেলেন ফেনীর অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি (১৮)।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জাতীয় সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বেনারকে জানান, দুপুর পর্যন্ত শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেও, রাত সাড়ে ৮টার পর থেকে তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে।

“নুসরাতের শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফুসফুস ও রক্তে সংক্রমণ ঘটেছিল। সবশেষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় সে,” জানান সামন্ত লাল সেন।

অধ্যাপক সেন আরও জানান, বুধবার সকালে সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালের চিকিৎসকদের সঙ্গে আবারও তাঁরা ভিডিও কনফারেন্সে বসেছিলেন। তাঁরা আবারও তাঁদের অপারগতার কথা জানান। সিঙ্গাপুরের চিকিৎ​সকেরা বলেন, সিঙ্গাপুরে যাবার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে পাঁচ ঘন্টার যাত্রার ধকল সইবার মতো অবস্থায় ছিল না নুসরাত।

মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করার পর সামন্ত লালকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাফির বাবা, ভাইসহ স্বজনেরা। সামাজি​ক যোগাযোগমাধ্যমে এই নিষ্ঠুর মৃত্যুকে ঘিরে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।

নুসরাতের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বিদেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ফেনীর একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার শ্লীলতাহানির চেষ্টার প্রতিবাদ করায় গত ৬ এপ্রিল তাঁর অনুগত লোকজন হাত-পা বেঁধে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন নুসরাত ফাজিল পরীক্ষা দিতে ওই কলেজ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন।

প্রায় ৮০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফেনী থেকে ঢাকা আসেন নুসরাত। গত দুদিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি।

আসার পথে বড় ভাই মাহমুদুল হাসানকে নুসরাত ঘটনার বিবরণ জানান। তাঁর ভাইয়ের কাছে থাকা ওই অডিও রেকর্ডে যন্ত্রণায় কাতর নুসরাতকে বলতে শোনা যায়, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নুসরাত তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন।

“আমি এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করব—শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত...-এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করব, আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব, সারা দুনিয়ার কাছে বলব, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব,” নুসরাত তাঁর ভাই মাহমুদুল হাসানকে বলেছিলেন।

নুসরাতের এই অবস্থান সারা দেশের মানুষকে নাড়া দেয়। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক হোসাইন ইমাম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।

“যে মরে গেল, সে বেঁচে গেল। আর যারা বেঁচে রইল, তারা সবাই হেরে গেল,” হোসাইন ইমাম লেখেন।

বুধবার রাতে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বাইরে বসেছিলেন নুসরাতের বাবা একেএম মুসা। একটু পরপর তিনি ‘মা’ ‘মা’ বলে আহাজারি করেছিলেন। তাঁকে শক্ত করে ধরে বসেছিলেন প্রতিবেশী রুবেল খান। বলছিলেন, মৃত মেয়ের কাছে যাওয়ার সাহস করছেন না বাবা।

“মৃত্যুর সময় নুসরাতের কাছে ওর মা শিরিন আক্তার ছিলেন। নুসরাতের বাবা মেয়ের মৃতমুখ দেখার মতো অবস্থায় নেই। ওর এই একটিই মেয়ে,” রুবেল খান বেনারনিউজকে বলছিলেন।

শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ

নুসরাতের চাচাতো ভাই মো. ফরহাদ বলছিলেন, তার যুদ্ধের শুরু ২৭ মার্চ থেকে। শ্লীলতাহানির মামলা দায়েরের পর থেকে নানাভাবে নুসরাতকে হেনস্থা করা হয়েছে। কিন্তু নুসরাত ওই দিন থেকে অনড় অবস্থানে ছিলেন। এমনকি কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পরও অবস্থান বদলাননি তিনি। নিজের ভাই, পুলিশ ও চিকিৎসকের কাছে জবানবন্দি দিয়ে গেছেন।

“এ​ই নৃশংস ঘটনার পর মামলা হলেও পুলিশ সহযোগিতা করেনি। পুলিশ তাদের সাজানো এজাহারে আমাদের স্বাক্ষর করিয়েছে। বুঝতে পেরে আমরা প্রতিবাদ করি। আবারও এজাহার হয়। আমরা মরতে বসা বোনটাকে নিয়ে দৌঁড়াব, নাকি প্রশাসন সামলাব,” মো. ফরহাদ বেনারনিউজকে বলেন।

উল্লেখ্য, পুলিশের তৈরি প্রথম এজাহারে শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত মাদ্রাসা শিক্ষক সিরাজ উদ দৌলার নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার পরিবর্তিত এজাহারে তাঁর নাম রয়েছে এক নম্বর আসামি হিসেবে। তাঁর রিমান্ড চলছে।

পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হলেও, প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি

নুসরাতকে নৃশংসভাবে হত্যার বিচার নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রশাসনে রদবদল আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা।

“বাদি পক্ষের অনাস্থার কারণে ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মো মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মামলার তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে,” সোহেল রানা বেনারনিউজকে বলেন।

বুধবার বিকেলেই মামলার কাগজপত্র বুঝে নেয় পিবিআই।

পুলিশ জানায়, এখন পর্যন্ত এই মামলায় গ্রেপ্তার আছে নয়জন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ সাতজন আছেন রিমান্ডে, দুজন কারাগারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নুসরাতের অডিও রেকর্ড, পুলিশের কাছে দেওয়া ঘটনার বর্ণনা ও ডাইং ডিক্লারেশন অমূল্য সাক্ষ্য। এর ভিত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথ সুগম হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।