যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করে প্রাণ দেওয়া ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে বেআইনিভাবে জেরা করে তার ভিডিও প্রচারের অভিযোগে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।
সোমবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন ওই ওসির বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করার নির্দেশ দেন। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এই মামলার প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
নুসরাত মারা যাওয়ার পরদিন ১১ এপ্রিল ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যেটি ধারণ করেন ওসি মোয়াজ্জেম। ওই ভিডিও ধারণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সোমবার মামলার আবেদন করেন পেশায় আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক।
সায়েদুল হক বেনারকে বলেন, “ওসি নিয়ম বহির্ভূতভাবে অনুমতি ছাড়া ভিডিও ধারণ করে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করেন। এছাড়া তিনি অপমানজনক ও আপত্তিকর ভাষা প্রয়োগ করেন। যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।”
এদিকে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় জড়িতদের কেউই আইনের হাত থেকে রেহাই পাবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নিহত নুসরাতের পরিবার তাঁর সাথে সাক্ষাত করলে তাঁদের সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি অপরাধীদের বিচার নিশ্চিতের বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবার সকালে নুসরাতের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান বলে জানায় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদ করে নুসরাত এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, “নুসরাতের মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হলো দেশে নারীরা খুব একটা নিরাপদ নয়।”
তিনি বলেন, “আগেও কিছু কিছু পুলিশ এমন ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। যে কারণে সেসব মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। নুসরাতের ঘটনায় আবারও সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি।”
অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, “আইন সম্পর্কে জেনেও ওসির কতবড় ধৃষ্টতা যে অভিযোগ করতে যাওয়া মেয়েটার অভিযোগ না নিয়ে অন্যায়ভাবে তার জেরার ভিডিও ধারণ করে সেটার প্রচার করল। সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি পজিটিভ।”
নুসরাত হত্যার সাথে জড়িতদের বিচারে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসকেও স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।
এই মামলার বিচার না হলে বাংলাদেশে নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভয়াবহ ধস নামবে বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী।
এলিনা খান বলেন, “এক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করতে চাই এই মামলার বিচার হবে এবং প্রাপ্য সাজা অপরাধীরা পাবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীদের আশ্বাসকে আমরা স্বাগত জানাই।”
উল্লেখ্য, ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা করেন। সেই মামলা তুলে না নেওয়ায় গত ৬ এপ্রিল তাঁর অনুগত লোকজন হাত-পা বেঁধে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন নুসরাত ফাজিল পরীক্ষা দিতে ওই কলেজ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন।
প্রায় ৮০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফেনী থেকে ঢাকা আসেন নুসরাত। দুদিন লাইফ সাপোর্টে থেকে ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।
ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের ধরতে গড়িমসির অভিযোগ উঠলে ১০ এপ্রিল মোয়াজ্জেম হোসেনকে সোনাগাজী থানার দায়িত্ব সরিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়।
যা আছে ভিডিওতে
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পাঁচ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, থানায় অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সময় ওসির সামনে অঝোরে কাঁদছিলেন নুসরাত। আর পুরো বিষয়টি ভিডিও করা হচ্ছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, মুখ দুই হাতে ঢেকে রেখেছিলেন নুসরাত। সে সময় ওসি মোয়াজ্জেম মুখ থেকে হাত সরাতে ও কান্না থামাতে বলেন। তাকে আরও বলতে শোনা যায়, “কাঁদতেছো কেন? এমন কিছু হয়নি যে এখনই তোমাকে কাঁদতে হবে।”
নুসরাত তার বর্ণনায় জানান, কলেজের অধ্যক্ষ পিয়নের মাধ্যমে তাকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে তার সাথে অশালীন আচরণ করেন। এসময় ওসি বলেন, “তিনি ডাকছিল নাকি তুমি গিয়েছিলে?”
এক পর্যায়ে নুসরাতকে বলতে শোনা যায়, “আমি বাঁচব না, স্যার।”
ওসির বিরুদ্ধে করা মামলার আবেদনে বলা হয়, গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে অধ্যক্ষ তাঁর কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠলে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন দুজনকে থানায় নিয়ে যান। নিয়ম ভেঙে জেরা করতে ওসি নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুই পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না।
মানবাধিকার কর্মী সালমা আলী বেনারকে বলেন, “ওসি মোয়াজ্জেম যা করেছেন তা অপরাধের মধ্যে পড়ে। কারণ, তিনি আইন অমান্য করে ভিকটিমের এ ধরনের ভিডিও ধারণ করেছেন। তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় পুলিশের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে না।”
আসামিদের দোষ স্বীকার
নুসরাত হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই আসামি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যার সাথে নিজেদের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। জবানবন্দি দেওয়া দুজন হলেন মামলার অন্যতম প্রধান আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন।
পিবিআিইয়ের এএসপি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন) তাহেরুল ইসলাম চৌহান রোববার সাংবাদিকদের বলেন, “চার দিনের মধ্যে ঘটনার মূল নায়কদের আইনের হাতে সোপর্দ করেছি। তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁদের আদালতে উপস্থাপন করেছেন। দুজন আসামি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিজ্ঞ আদালতের কাছে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বক্তব্যে তাঁরা পুরো বিষয়টা খোলাসা করেছেন- কীভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে, কোন আঙ্গিকে ঘটিয়েছে।”
তিনি বলেন, “তাঁরা স্বীকার করেছেন যে তাঁরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। আসামিদের কয়েকজন সরাসরি হত্যার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কয়েকজন পরিকল্পনায় অংশ নেন। তারা জেলখানা থেকে হুকুম পেয়েছেন। এই বিষগুলোর বিস্তারিত বর্ননা এসেছে।”
বিস্তারিত বিবরণ জানাতে রাজি হননি তিনি।
তবে সূত্র জানায়, গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে ৬ এপ্রিল তাঁর শরীরে আগুন লাগানোর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তাঁরা।
এক প্রশ্নের জবাবে তাহেরুল ইসলাম বলেন, “যে কয়জন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন তাঁদের দুজনকে আমরা আটক করতে পেরেছি। বাকিদেরও দ্রুত আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।”
নুসরাতের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বেনারকে বলেন, “আসামিদের জবানবন্দির কপি আমরা এখনো পাইনি। কাউকেই দেওয়া হচ্ছে না। অন্য কাদের নাম এসেছে সেটা সিবিআই প্রকাশ করেনি।”
ঘটনার পর বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে জানিয়েছিলেন দুর্বৃত্তরা। এই হত্যার ঘটনায় মাকসুদ এখন কারাগারে।