চাঁপাইনবাবগঞ্জে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড

পুলক ঘটক
2019.04.18
ঢাকা
190418_Five_death_penalty_1000.jpg রাজধানীর শাহবাগে গায়ে কাফনের কাপড় জড়িয়ে ধর্ষণ, নিপীড়ন ও বিচারহীনতার প্রতীকী প্রতিবাদ জানান তরুণীরা। ১৭ এপ্রিল ২০১৯।
নিউজরুম ফটো

পাঁচ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় দায়ী পাঁচ ব্যাক্তিকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ চলার মধ্যে আদালত এই রায় দিলো।

বৃহস্পতিবার জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মো. শওকত আলী এ রায় ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে আদালত তাদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে।

“আদালতে ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি তর্কে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারক পাঁচজনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন,” বেনারকে বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আঞ্জুমান আরা।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন; সদর উপজেলার মালবাগডাঙ্গা গ্রামের শ্যামাপদ রবিদাসের ছেলে নয়ন রবিদাস (২৮), সোনাপট্টি গ্রামের বীরেন রবিদাসের ছেলে প্রশান্ত রবিদাস (২২), চাকপাড়া গ্রামের রতন রবিদাসের ছেলে নিতাইচন্দ্র রবিদাস (২৬), সুচেন দাসের ছেলে সুভাষ দাস (৪২) ও খোকন রবিদাসের ছেলে প্রশান্ত রবিদাস (২৪)।

রায় ঘোষণার সময় দুই আসামি, নয়ন ও প্রশান্ত আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাকিরা পলাতক রয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তিন আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছে।

এদিকে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। বুধবার ঢাকায় এক দল নারী কাফন পরে যৌন নির্যাতনের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এমন প্রতিবাদ মুখর সময় আদালতের এই রায়কে ‘গুরুত্ববহ বার্তা’ হিসেবে দেখছেন অধিকার কর্মীরা।

এ রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্ট নারী অধিকার কর্মী খুশী কবির বেনারকে বলেছেন, “বহুল আলোচিত ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে বিচারহীনতার সংস্কৃতির দায় থেকে থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।”

“কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাসহ যেসব ঘটনায় সরকার এখনো অপরাধীদের আদালতের দ্বারস্থ করতে পারেনি, সেসব ঘটনার তদন্ত ও বিচার ত্বরান্বিত করা দরকার,” বলেন তিনি।

প্রেমের প্রলোভনে খুন

মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৩ জুন সন্ধ্যার পর সদর উপজেলার কালিনগর বাবলাবোনা গ্রামের মফিজুল ইসলামের মেয়ে আয়েশা খাতুন মামার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। পরের দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের মহাসড়কের পাশের একটি গর্তের পানিতে ভাসমান অবস্থায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের পর হত্যার তথ্য আসে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার পরিদর্শক সারোয়ার রহমান অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, “আসামি নয়ন প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে আয়েশা খাতুনকে ১৩ জুন ডেকে নিয়ে দল বেঁধে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।”

খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সদর উপজেলার বাথানপাড়া গ্রামের অনীল শিলের ছেলে শ্রীকৃষ্ণ (২৩), হরিশপুরের আতাবুরের ছেলে আব্দুর রহিম (৩৫) ও রাজশাহীর জিয়া কলোনির আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী সোহাগী বেগম (২৭)।

১৫ দিনে ৪৭ শিশুর যৌন নিগ্রহ

চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। বুধবার এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’।

এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৩৯ জন। বিভিন্ন কারণে হত্যা করা হয়েছে ৫ শিশুকে, যার মধ্যে ৪ জন ছেলে ও ১ জন মেয়ে শিশু। ২ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি।

“বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে,” বিবৃতিতে দাবি করেছে এই মানবাধিকার সংগঠন।

সরকার ২০০১ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ঢাকাসহ ৮টি জেলায় ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সেন্টারগুলো থেকে ৪ হাজার ৫৪১টি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২২৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে মাত্র ৬০টিতে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছেন। অন্যদিকে, ৩ হাজার ৩১২টি মামলার নিষ্পত্তিই হয়নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা বাংলাদেশের ৩০০টি ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশে ধর্ষণের তদন্ত এখনো মান্ধাতা আমলের। সবচেয়ে বড় কথা আদালতে এবং পুলিশি অঙ্গনে নারীবান্ধব পরিবেশ নেই।”

“আইনের দুর্বলতার কারণে অনেক ধর্ষক পার পেয়ে যাচ্ছে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া ধর্ষণ না কমার অন্যতম কারণ,” বলেন তিনি।

কাফনের কাপড় পরে প্রতিবাদ

বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে গায়ে কাফনের কাপড় জড়িয়ে ধর্ষণ, নিপীড়ন ও বিচারহীনতার প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েছন ১০ তরুণী। তাঁদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘‘আমি ‘মানুষ’, বিচারহীন রাষ্ট্রে খুন ও ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছি, ভিকটিম পক্ষ।”

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেশব্যাপী চলমান প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্যে তাঁদের এই আয়োজন ছিল ব্যতিক্রমী। কাফনের কাপড় মোড়ানো ওই প্রতিবাদী নারীদের পাশেই জ্বলছিল আগরবাতি। একজন মাঝে মাঝে তাদের ওপর গোলাপজল ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন।

‘ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি’ নামে এই প্রতীকী প্রতিবাদের প্রধান সংগঠক শারমিন জাহান অর্পি বেনারকে বলেন, “আমরা এ রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে ক্লান্ত।”

“আমাদের মনে হয়েছে, রাষ্ট্রের কাছে নিপীড়কের বিচার না চেয়ে আমাদের নিজেদেরই খুন বা ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেয়া উচিত। তাই আমাদের এ ধরনের প্রতিবাদ,” বলেন অর্পি।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় তনু, নুসরাতসহ অসংখ্য নারী নিপীড়িত হচ্ছেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।