বরগুনা হত্যাকাণ্ড: প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

জেসমিন পাপড়ি
2019.07.02
ঢাকা
190702_Crossfire-Nayon_1000.jpg রিফাত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশ। ২৭ জুন ২০১৯। [নিউজরুম ফটো]
[নিউজরুম ফটো]

বরগুনায় রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের ছয় দিনের মাথায় মঙ্গলবার ভোর ৪টার দিকে বরগুনার বুড়িরচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন।

তিনি জানান, “গোপন খবরের ভিত্তিতে নয়নকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের একটি দল অভিযানে বের হয়। ভোরের দিকে বুড়ির চর গ্রামে পৌঁছালে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা পুলিশের দিকে গুলি করে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়।”

“কিছু সময় গোলাগুলি চলার পর অজ্ঞাত ব্যক্তিরা পালিয়ে যায়। পরে সেখানে নয়নের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।”

ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, একটি গুলি এবং তিনটি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয় বলে জানান পুলিশ সুপার। এ অভিযানে চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলেও জানান মারুফ হোসেন।

বরগুনা শহরের আবু বক্কর সিদ্দিকীর ছেলে নয়নের বিরুদ্ধে মাদক কেনাবেচা, চুরি, ছিনতাই, হামলা, সন্ত্রাস সৃষ্টিসহ নানা অভিযোগে অন্তত আটটি মামলা রয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন।

উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে রিফাত শরীফকে (২৫) স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে জখম করে একদল যুবক। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ২৭ জুন ১২ আসামির নাম উল্লেখ করে বরগুনা সদর থানায় হত্যা মামলা করেন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ। অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়।

এ পর্যন্ত রিফাত হত্যা মামলায় নয়জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। যাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত চারজন। তবে নয়নের প্রধান সহযোগী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী নামে দুই ভাইকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ।

পরিবার সস্তুষ্ট, উদ্বিগ্ন মানবাধিকার কর্মীরা

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যায় এই যুক্তিতে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের আসামির এই পরিণতিকে সমর্থন করছে নিহতের পরিবার। তবে কথিত এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁদের মতে, এভাবে বিনা বিচারে হত্যা জঘন্য অপরাধ।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “বিষয়টি বিচার বিভাগের জন্য লজ্জার। একের পর এক বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার ঘটার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নিয়ে বিচার বিভাগের ভাবা উচিত।”

তিনি বলেন, “আর যদি সত্যিই বন্দুকযুদ্ধ ঘটে, তবে সেটা পুলিশের অদক্ষতাকেও প্রমাণ করে। একজন আসামিকে ধরতে যাচ্ছে অথচ তার নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি, এটা নির্বাহী বিভাগের জন্যও লজ্জার।”

তবে আসামি নয়ন বন্ডের নিহত হওয়ার খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছে নিহত রিফাতের পরিবার।

তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বেনারকে বলেন, “চোখের সামনে নৃশংসভাবে নিজের স্বামীকে মারতে দেখেছি। আমি এমন একটা খবরের অপেক্ষাতেই ছিলাম।”

“এখন বিচারের জন্য আদালতে দৌড়াতে হবে না। বিচার হবে কি না তা নিয়ে সব শঙ্কা এবং আতঙ্ক দূর হলো,” বলেন মিন্নি।

এ ঘটনায় জড়িত অন্যদেরও কঠোর শাস্তি কামনা করেন তিনি।

একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রিফাতের বাবা দুলাল শরীফও বেনারকে বলেন, “এবার একটু হলেও আমার একমাত্র ছেলের আত্মা শান্তি পাবে।”

এই আসামিরা কাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানান দুলাল শরীফ।

এদিকে বন্দুকযুদ্ধে নয়ন বন্ড নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে মঙ্গলবার বলা হয়, “পুলিশ প্রশাসন এ ধরনের জঘন্য সব অপরাধ প্রবণতা রোধে বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডকে একটি সমাধান হিসেবে ধরে নিচ্ছে।”

“কিন্তু সাময়িকভাবে এ ব্যবস্থা স্বস্তি এনে দিলেও তা সমাজকে চরম সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটি দেশে প্রচলিত আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থার প্রতি চরম আস্থাহীনতা তৈরি করছে,” বলা হয় বিবৃতিতে।

এসব ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে আসক।

ছয় মাসে বিচারবিহর্ভূত হত্যা ২০৪

চলতি বছরে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধে ও হেফাজতে ২০৪ জন মারা গেছেন বলে জানায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

গত জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের প্রথম সারির নয়টি জাতীয় দৈনিকে (তিনটি ইংরেজি পত্রিকা) প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে আসক। গত সোমবার প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

নিহতদের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৯২, র‍্যাবের সঙ্গে ৫৯ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮ জন নিহত হয়েছেন।

আসকের হিসাবে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ৪৬৬ জন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।