শেখ হাসিনার ট্রেনে হামলা: নয়জনের মৃত্যুদণ্ড, পঁচিশজনের যাবজ্জীবন

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.07.03
ঢাকা
190703_Death_Penalty_Shooting_Hasina_1000.jpg ১৯৯৪ সালে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে হামলা ও গুলিবর্ষণের মামলার রায় ঘোষণার পর পাবনার আদালত প্রাঙ্গনে দণ্ডপ্রাপ্তদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৩ জুলাই ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

পঁচিশ বছর আগে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় নয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। বুধবার পাবনার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-১ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক রোস্তম আলী এ রায় ঘোষণা করেন।

একই মামলায় ২৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৩ জনকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন বিচারক। সাজাপ্রাপ্তরা সবাই বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের সদস্য।

বুধবারের রায়টি শেখ হাসিনার প্রাণনাশ চেষ্টা মামলার তৃতীয় রায়। এর আগে ২০০০ সালে কোটালিপাড়ার বোমা মামলা এবং ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে এই রায়কে “বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন,” বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মামলার রায়ের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মির্জা ফখরুল বেনারকে বলেন, “যেহেতু আমরা বর্তমান সরকারের প্রচণ্ড রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, সেহেতু বলা যায় এই রায়ে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন ঘটেছে।”

তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের আমলে বিচার ব্যবস্থাকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে।”

“আক্রমণের ধরন বিবেচনা করলে এই রায় মেনে নেয়া যায় না,” মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “শেখ হাসিনার ওপর আক্রমণ অবশ্যই নিন্দনীয়। তবে যেভাবে মামলাটি তদন্ত করা হয়েছে সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যায়। তদন্ত হতে হবে স্বচ্ছ।”

আসামি পক্ষের আইনজীবী মাসুদ খন্দকার বেনারকে বলেন, “আমরা এই রায়ে ক্ষুদ্ধ। আমরা ন্যয় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।”

তিনি বলেন, “এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। ১ জুলাই মামলাটির শুনানি হয়েছে। আর রায় ঘোষণা করা হলো ৩ জুলাই। এই মামলায় মোট ৬০ জন সাক্ষী ছিলেন। এফআইআরসহ মোট এক হাজার পাতার রেকর্ড আছে এই মামলার সাথে। একদিনে এতগুলো কাগজ পড়ে এবং সাক্ষী নিয়ে রায় দেয়া সম্ভব?”

মাসুদ খন্দকার বলেন, “দণ্ডপ্রাপ্তরা এ-টু-জেড সকলে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের সদস্য। সুতরাং বলাই যায় এটি রাজনৈতিক কারণে করা হয়েছে।”

তাঁর প্রশ্ন, “শেখ হাসিনা ঈশ্বরদী এসেছিলেন বিকেল পাঁচটায়। আর আক্রমণের ঘটনা ঘটে সকাল ১০টায়। তাহলে শেখ হাসিনাকে কীভাবে হত্যা চেষ্টা হলো?”

আসামিপক্ষের অভিযোগ অস্বীকার করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি আখতারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “মামলাটি প্রায় ২৫ বছর ধরে চলমান। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা মামলাটিকে বন্ধ করার সকল ব্যবস্থা করে। আসামিদের পক্ষে ৫৭ জন সাফাই সাক্ষী দিয়েছে। আরগুমেন্ট হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এই হামলায় সাজাপ্রাপ্তরা সন্দেহাতীতভাবে জড়িত ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। রায়ে তাই বলা হয়েছে।”

আখতারুজ্জামান বলেন, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা খুলনা থেকে সৈয়দপুর যাওয়ার পথে ঈশ্বরদী স্টেশনে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে উনার জনসভায় বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল।

তিনি বলেন, “বিএনপি নেতা–কর্মীরা সকাল এগারোটার দিকে আক্রমণ করে শেখ হাসিনার মঞ্চ ভেঙে দেয়। তারা দফায় দফায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ওপর বোমা ও গুলি বর্ষণ করে।”

আখতারুজ্জামান আরও বলেন, “শেখ হাসিনা ঈশ্বরদী নামতে না পেরে ট্রেনের মধ্যে থেকে বক্তৃতা শুরু করেন। এর মধ্যেই বিএনপি নেতা-কর্মীরা শত শত রাউন্ড গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। একটি বোমা শেখ হাসিনার কামরার প্রায় চার ফুট দূরে বিস্ফোরিত হয়। উনি অল্পের জন্য রক্ষা পান। পরে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে গুলির নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।”

ওই ঘটনায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক মেয়র মোকলেছুর রহমান বাবলু, পাবনা জেলা বিএনপির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক একেএম আকতারুজ্জামান, ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, পৌর যুবদলের সভাপতি মোস্তফা নূরে আলম শ্যামল, বিএনপি নেতা মাহবুবুল রহমান পলাশ, শামছুল আলম, শহীদুল ইসলাম অটল, রেজাউল করিম শাহীন ও আজিজুর রহমান শাহীন।

এই মামলায় অভিযুক্ত মোট ৫২ জনের মধ্যে ৫ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন, ৩৩ জন জেল হাজতে ও ১৪ জন পলাতক রয়েছেন।

১৯৯৪ সালে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে হামলা ও গুলিবর্ষণের মামলার রায় ঘোষণার পর পাবনার আদালত থেকে আসামিদের কারাগারে নেওয়া হয়। ৩ জুলাই ২০১৯।
১৯৯৪ সালে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে হামলা ও গুলিবর্ষণের মামলার রায় ঘোষণার পর পাবনার আদালত থেকে আসামিদের কারাগারে নেওয়া হয়। ৩ জুলাই ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

শেখ হাসিনার ওপর আক্রমণ

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও তাঁর একমাত্র বোন শেখ রেহানা।

১৯৮১ সালে দেশে ‍ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পাওয়ার পর থেকে দফায় দফায় আক্রমণ হয় শেখ হাসিনার ওপর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

তাঁর ওপর প্রথম বড় আক্রমণের পরিকল্পনা হয় ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান।

ওই হত্যা মামলায় হান্নানসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে পুলিশ। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল আরেক মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করে সরকার।

২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল কোটালিপাড়া বোমা মামলায় ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। মামলাটি হাইকোর্ট বিচারাধীন।

তবে শেখ হাসিনার ওপর সবচে বড় আক্রমণ হয় ২০০৪ সালে বিএনপি শাসনামলে। ওই বছর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায় হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা।

শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও ওই ঘটনায় প্রাণ হারান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ কমপক্ষে ২৩ জন। পুলিশ তদন্ত করে জানায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের ব্যবহার করেন।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার একটি আদালত ২১ আগস্ট হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এ ছাড়া তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও ১৯ জনের ফাঁসি দেয়া হয়।

তবে ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনার ওপর আক্রমণটি ছিল অন্যান্য আক্রমণের চেয়ে তুলনামূলক ‘দুর্বল’ প্রকৃতির। ওই হামলায় শেখ হাসিনার রেলের কামরা লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলেও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।