নোয়াখালীর ঘটনার জের, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারাদেশে বিক্ষোভ

পুলক ঘটক
2020.10.06
ঢাকা
bd-rape-1000.jpg ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র-জনসাধারণের বিক্ষোভ। ৬ অক্টোবর ২০২০।
[ফোকাস বাংলা]

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্মমভাবে নির্যাতনের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকাসহ সারা দেশে মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।

প্রতিবাদে যোগ দিতে সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনকে রাজধানীর শাহবাগ, উত্তরা এবং গুলশান অঞ্চলে ভিড় করতে দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীরা এই জঘন্য অপরাধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পদত্যাগের দাবি করছিলেন।

রাজধানীর শাহবাগ থেকে একটি ধর্ষণবিরোধী কালো পতাকা মিছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ।

বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে অন্তত ১০ জন আহত হন।

এর প্রতিবাদে সন্ধ্যায় মশাল মিছিল ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর কর্মসূচি পালন করেন ছাত্ররা।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বেনারকে বলেছেন, “পুলিশ বিনা উস্কানিতে আমাদের পিটিয়েছে। লাঠিপেটায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।”

রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশকে এক পর্যায়ে সামান্য লাঠিচার্জ করতে হয়েছে, কারণ তাঁরা কোনো বাধাই মানছিলেন না।”

মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ের সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “পুলিশ সিলেটের এমসি কলেজ ঘটনায় সমস্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনাটি বর্বরতার চরম। ঐ ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে, এজাহারভুক্ত দুই আসামি ধরা বাকি আছে।”

তিনি বলেন, “আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাৎণিকভাবে এবং কঠোরভাবে কাজ করেছে। তাদের কোনো গাফিলতি নেই। সমস্ত অপরাধী অবশ্যই আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে।”

রোববার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, বন্ধ ঘরে টর্চলাইটের আলোয় এক নারীকে টেনে হিঁচড়ে বিবস্ত্র করা হচ্ছিল এবং নির্দয়ভাবে মারা হচ্ছিল। নারীটি আহাজারি করছিলেন, ওরে আব্বারে– তোগো আল্লার দোহাই, আমারে ছাইড়া দে।”

কিন্তু কেউ তাঁকে সহায়তায় এগিয়ে আসেনি।

এক মাস আগে (২ সেপ্টেম্বর) সংঘটিত ঐ ঘটনার দৃশ্যটি ‘ভাইরাল’ হওয়ার পর রবিবার রাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীকে (৩৫) খুঁজে বের করে পুলিশ। এরপর দায়ীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেন নির্যাতিতা।

নারীর প্রতি সহিংস কেন?

নোয়াখালীর ঘটনায় ন্যায়বিচার দাবি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার গবেষক সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “এই ফুটেজ বাংলাদেশে নারীদের নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হওয়ার বাস্তব চিত্র প্রদর্শন করে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার ব্যবস্থা অপরাধীদের সাজা দিতে ব্যর্থ হয়।”

“বাংলাদেশকে এর নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। এ ধরনের জঘন্য হামলার জন্য দায়ীদের শাস্তি দিতে হবে,” বলেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে ঘাটতি থাকার কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব জোরালো হওয়ায় নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে।

সমাজকর্মী ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মাহমুদ বেনারকে বলেছেন, “পুরুষতান্ত্রিক এই দেশে নারীদের বিরুদ্ধে জিঘাংসার মনোভাব বেড়েছে। এক শ্রেণির মানুষ মনে করছে নারীর ওপর বল প্রয়োগ করা যায়। গণতন্ত্রহীনতা এবং মৌলবাদী রাজনীতির প্রসারের কারণে এটা হয়েছে।”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম বেনারকে বলেছেন, “বিচার বিলম্ব হওয়াই প্রধান সমস্যা। দুস্কৃতকারীরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস পাচ্ছে। নারীবিরোধী রাজনীতি এবং প্রচারণা, যা নারীকে আবদ্ধ করে রাখতে চায়, তা প্রসার লাভ করেছে। ফলে নারীদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে।”

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বেনারনিউজকে বলেছেন, “চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিনজন নারী ধর্ষিত হয়েছে।”

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি করা আসকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, উল্লেখিত সময়ের মধ্যে ৯৭৫ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ২০৮টি ছিল গণধর্ষণ।

‘আগেও দুইবার ধর্ষণ’

নির্যাতনের ভিডিও করার আগেও ঐ নারীকে দুইবার ধর্ষণ করেছিলেন স্থানীয় দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তদলের কাছে নির্যাতনের শিকার ওই নারী মঙ্গলবার এমন অভিযোগ করেছেন।

তদন্ত শেষে মঙ্গলবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) ও তদন্তদলের প্রধান আল-মাহমুদ ফয়জুল কবীর সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, ঐ নারী জানিয়েছেন দেলোয়ার প্রায় সময় তাঁকে অশোভন প্রস্তাব দিতেন এবং রাজি করার জন্য হুমকি-ধমকিও দিতেন। বছর খানেক আগে দেলোয়ার তাঁর ঘরে ঢুকে তাঁকে প্রথমবার ধর্ষণ করেন।

ভয়ে ও লোকলজ্জায় তিনি এ ঘটনা প্রকাশ করার সাহস পাননি। এরপর গেল রমজানের কিছুদিন আগে দেলোয়ার তাঁর সহযোগী কালামের মাধ্যমে ওই নারীকে একটি নৌকায় ডেকে নিয়ে দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করেন।

আল-মাহমুদ ফয়জুল কবীর বলেন, দেলোয়ার ও কালামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে পৃথক একটি মামলা করতে ঐ নারীকে সহযোগিতা করবে মানবাধিকার কমিশন। এ ক্ষেত্রে কমিশনের প্যানেল আইনজীবীরা আদালতে মামলাটি পরিচালনা করবেন।

দায়েরকৃত দুই মামলার বিবরণ অনুযায়ী স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে একলাশপুরে বাবার বাড়িতে থাকতেন ওই নারী। ১০ বছর পর গত ২ সেপ্টেম্বর স্বামী তাঁর কাছে এলে দেলোয়ার বাহিনীর ক্যাডাররা দরজা ভেঙে ওই নারীর ঘরে ঢোকে।

এরপর তারা ওই নারীর স্বামীকে পাশের রুমে বেঁধে রেখে তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে।

এরপর থেকে ওই নারী এলাকাছাড়া হয়ে পালিয়ে থাকলেও তাঁকে মোবাইলফোনে নানা ধরনের হুমকি ও কুপ্রস্তাব দিতো দেলোয়ার বাহিনী। তিনি ফিরে না আসায় গত ৪ অক্টোবর সে ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ করে দুর্বৃত্তরা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।