ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, অধ্যাদেশ জারির প্রস্তুতি

প্রাপ্তি রহমান
2020.10.12
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
201009_Rape_Protest-Bangla_1000.jpg ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগে সমাবেশে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরা। ১২ অক্টোবর ২০২০।
[নিউজরুম ফটো]

দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনের মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সভায় খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সভা শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সাজা বাড়ানো হয়েছে পরিস্থিতির কারণে। মঙ্গলবার এ সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারি হবে।

“সাজা বাড়ানোর যে ব্যাপারটা, এটা পরিস্থিতির কারণে। আপনারা জানেন, বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে অনেক বিতর্ক আছে। তারপরেও আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটির যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, সে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এটা বাড়ানো উচিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটি সংশোধনীতে এনেছি,” আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন।

তিনি আরও বলেন, “মৃত্যুদণ্ডের বিধান জারির পাশাপাশি ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়া যেন দ্রুততার সঙ্গে হয় তাও নিশ্চিত করা হবে।”

সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত হলে ভীতি তৈরি হবে। সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে কঠোর আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন আছে।”

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

মন্ত্রিপরিষদ সভাটি ছিল ভার্চুয়াল এবং এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন। অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে বলে, আইনের খসড়াটি নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয় বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

বর্তমানে সংসদ অধিবেশন চলমান না থাকায়, সংশোধিত আইনটি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হতে পারে বলেও জানান সচিব।

এর আগে রোববার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মনে হয়, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলে কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধ করার আগে অনেকবার ভাববে।”

তবে মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণ প্রতিরোধ করবে এ মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা মনে করছেন আন্দোলনকে ধামাচাপা দিতেই সরকার তড়িঘড়ি করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নীনা গোস্বামী জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বেনারনিউজকে বলেন, “এখন যে আইন রয়েছে তাতে ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ধর্ষণের পর হত্যার সাজা মৃত্যুদণ্ড। এ পর্যন্ত কজনকে বিচারের আওতায় আনা গেছে? কোথাও কোথাও সাজা হয়েছে আসামি পালিয়ে গেছে। সাজা বাড়ালেই ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, বিষয়টা এমন না।”

গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে একজন গৃহবধুকে গণধর্ষণ এবং এর নয়দিনের মাথায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই ছাত্র-শিক্ষক-মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শাহবাগে ধারাবাহিকভাবে ধর্ষণের বিচার চেয়ে আন্দোলন চলে।

আন্দোলনকারীদের একাংশের তরফ থেকে মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলা হয়। পরবর্তীতে এই দাবির পক্ষে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ ভিডিও বার্তায় বলেন, “দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চায়।”

দিনে গড়ে তিনটি ধর্ষণ

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে চলতি বছরের প্রথম নয়মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে ধর্ষণ হয়েছে তিনটি করে।

বর্তমানে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০৩ (সংশোধনী) অনুযায়ী ধর্ষণের বিচার হয়ে থাকে। এই আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু ধর্ষণের পর হত্যা ও গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। তবে আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে গত দুই বছর ধরে ধর্ষণ আইন সংস্কারের কাজ করছে ১৭টি সংগঠনের জোট। ওই জোটের পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। ১৭ সংগঠনের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা খালাস এর বাইরে আর কোনো বিকল্প না থাকায় বিচারকরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সমস্যায় পড়ছেন বলে মনে করে এই জোট।

ব্লাস্টের রিসার্চ স্পেশালিস্ট তাকবির হুদা বলছেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেই ধর্ষণ কমে যাবে এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটা স্তরে বাধার সম্মুখীন হয় এবং বিচারবিমুখ হয়ে পড়ে।

“ধর্ষণের শিকার যারা হচ্ছে তারা ধর্ষণকারীদের তুলনায় অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে সাধারণত দুর্বল। তারা প্রথম ধাক্কাটা খায় মামলা করতে গিয়ে। মামলা করলেও সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় তাঁদের জীবনাশঙ্কা থাকে, এরপর আদালতেও তারা অপ্রীতিকর জেরার সম্মুখীন হয়,” তাকবির বেনারনিউজকে বলেন।

সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রবর্তন, সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা প্রত্যাহারসহ বেশ কিছু জায়গায় সংশোধন না করলে নারী শিশুরা বিচারপ্রার্থী হবেন না বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে নিম্ন আদালতের বিচারক শওকত হোসেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শঙ্কার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা বাড়বে। তাছাড়া তৈরি হবে আপসের সুযোগ।

“বেশিরভাগ সময় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ও ধর্ষক পূর্বপরিচিত হয়ে থাকে, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে। ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ তৈরি হবে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার জন্য,” শওকত হোসেন ফেসবুকে লেখেন।

আন্দোলন ও পুলিশি তৎপরতার পরও ঘটেছে ধর্ষণ

দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনের মধ্যেই রোববার ঢাকার পল্লবীতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে শিশু, বাগেরহাটের ফকিরহাটে ঘরে ঢুকে একজন এনজিও কর্মীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, গণধর্ষণের শিকার শিশুটি বাবার সঙ্গে রাগ করে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর সে হারিয়ে যায়।

“বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে চার যুবক। ধর্ষণের আগে শিশুটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল তারা,” কাজী ওয়াজেদ আলী বেনারনিউজকে বলেন। তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার চারজনকে সোমবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে তারা।

বাগেরহাটে এনজিও কর্মীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণের অভিযোগে মামুন শেখ নামের একজন রিকশাচালক গ্রেপ্তার হন। তাঁর কাছ থেকে ভিডিও উদ্ধার হয়েছে বলেও জানান ফকিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ ন ম খায়রুল আনাম।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বলেছেন, “সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিটি মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব মামলার তদন্ত শেষ করে বিচারের জন্য তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।