ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, অধ্যাদেশ জারি

জেসমিন পাপড়ি
2020.10.13
ঢাকা
201013_Death_sentence_1000.JPG সারাদেশে অব্যাহত নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জ থেকে ১০০ কিলোমিটার পদযাত্রা করে করে ঢাকায় এসে পৌঁছান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। ১৩ অক্টোবর ২০২০।
[নিউজরুম ফটো]

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশে মঙ্গলবার সই করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। এর ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সপ্তম দেশ যেখানে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্দোলন ও দাবির মুখে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব জয়নাল আবেদীন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, ওই খসড়াটি রাষ্ট্রপতি সই করার পর অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়েছে।

আগের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। এখন সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যের বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক খবরে মঙ্গলবার বলা হয়, বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য ছয়টি দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এগুলো হচ্ছে; ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীন।

ওই খবরে বলা হয়, ২০১৮ সালে ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে টানা বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে ভারতে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। সৌদি আরবে ২০১৯ সালে ধর্ষণের দায়ে ফাঁসি হয়েছে ছয়জনের।

এ ছাড়া পাকিস্তানে গণধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ২০১৯ সালে ইরানে ১২ জনের ফাঁসি হয়েছে ধর্ষণের দায়ে।

১৪ বছরের নিচে কোনো শিশু বা নারী ধর্ষণের ফলে গুরুতর আহত হলে বা মারা গেলে চীনের ফৌজদারি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

বাংলাদেশে ধর্ষণের কয়েকটি বর্বরোচিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি জোরদার হয়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আরেক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ৪ অক্টোবর ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

ধর্ষণ-নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে। এসব কর্মসূচি থেকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি তোলা হয়।

সরকারের একাধিক মন্ত্রী গত দুদিনে বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করায় এই অপরাধ কমে আসবে বলে তাঁদের বিশ্বাস।

তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় “অপরাধীরা প্রমাণ নষ্ট করার জন্য নির্যাতিতাকে মেরে ফেলতে পারে—এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী।

তিনি বেনারকে বলেন, “শুধু শাস্তির মাত্রা বাড়ালেই বিচার হয় না, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ধর্ষণের সংজ্ঞাসহ আরো অনেক কিছু পরিবর্তন করা দরকার।”

“২০ বছর আগে প্রণীত হওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিধিমালা তৈরি করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের জবাবদিওহি বেশ গুরুত্বপূর্ণ,” যোগ করেন তিনি।

এদিকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

ধর্ষণ একটা পাশবিকতা: প্রধানমন্ত্রী

রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অ্যাসিড–সন্ত্রাসের মতো ধর্ষণ নামের পাশবিকতা নিয়ন্ত্রণেই তাঁর সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংযুক্ত করেছে।

তিনি বলেন, “ধর্ষণ একটা পাশবিকতা, মানুষ পশু হয়ে যায়। এর ফলে আমাদের মেয়েরা আজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে জন্য আমরা আইনটি সংশোধন করেছি।”

প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এ কথা বলেন।

“যেহেতু, পার্লামেন্ট সেশনে নেই, তাই আমরা এ ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করে দিচ্ছি,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।

মোমবাতি হাতে নীরব প্রতিবাদ

রাজধানীর উত্তরার বিএনএস সেন্টারে সামনে জড়ো হয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। দেশের আনাচে–কানাচে বিভিন্ন সময় ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করেন সবাই। এরপর মোমবাতি হাতে নিয়ে নীরব প্রতিবাদ জানান তাঁরা।

এর আগে তাঁরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন, পাঠ করেন শপথবাক্য।

পায়ে হেঁটে প্রতিবাদ

দেশে অব্যাহত ধর্ষণ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী। শনিবার বিকেলে কিশোরগঞ্জ থেকে হাঁটা শুরু করেন তাঁরা। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তাঁরা ঢাকার শাহবাগে পৌঁছান।

শিক্ষার্থীরা হলেন; দর্শন বিভাগের ইফতিখার আলম, ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তানভীর সাকলাইন, অর্থনীতি বিভাগের বিডি রায়হান ও সংগীত বিভাগের আশফাক অনিক। দেশে ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ থেকে এ কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা।

এদিকে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা নিয়ে দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলনকারী ও সরকারপক্ষ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে। মানবাধিকার সংগঠন ও কিছু বাম ঘরানার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন মনে করে মৃত্যুদণ্ড দিলেই ধর্ষণ কমবে না।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “ফাঁসি কোনো সমাধান হতে পারে না। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ফাঁসি কার্যকর করলে ধর্ষণ কমে আসবে বলে মনে করি না। আমাদের দেশে অনেক অপরাধের জন্য মাত্রা ভেদে ফাঁসির দণ্ডাদেশ রয়েছে। তাই বলে সেসব অপরাধ কমে গেছে বা বন্ধ হয়েছে—এটা বলা যায় না।”

“এক্ষেত্রেও ফাঁসির দণ্ডাদেশের চেয়ে জরুরি ছিল আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সংক্ষিপ্ত সময়ে বিচার শেষ করা; সর্বোপরি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। সমাজে এমন একটি বার্তা দেওয়া যে, সমাজে এ ধরনের অপরাধ করে কেউ পার পাবে না,” বলেন নূর খান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।