গণধর্ষণের ঘটনায় পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড

জেসমিন পাপড়ি
2020.10.15
ঢাকা
201015_Death_Rape_1000.JPG ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে ঢাকায় আলোকচিত্র সাংবাদিকদের মানববন্ধন। ১১ অক্টোবর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

টাঙ্গাইলে আট বছর আগে এক মাদ্রাসাছাত্রীকে (১৫) অপহরণের পর দল বেঁধে ধর্ষণের দায়ে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত।

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে অধ্যাদেশ জারির মাত্র দুদিন পর এই রায় হলেও রায়টি দেয়া হয়েছে পুরোনো আইনের একটি ধারায়।

বৃহস্পতিবার দুপুরে টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক খালেদা ইয়াসমিন এ আদেশ দেন। পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন আদালত।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) এ কে এম নাছিমুল আক্তার বেনারকে বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতন (সংশোধিত) আইন ২০০৩ এর ৯(৩)/৩০ ধারার অধীনে রায়টি হয়েছে।”

আইনটির ওই ধারা অনুযায়ী গণধর্ষণের ঘটনায় কোনো নারী বা শিশুর যদি “মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন” তাহলে ধর্ষকদলের প্রত্যেকে “মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।”

“নারী ও শিশু আইনের পুরোনো ধারাতেই গণধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা রয়েছে। তবে এটি বহুল প্রচলিত নয়,” বলেন নাছিমুল আক্তার।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, ধর্ষণ ঠেকাতে দু’একটি মামলার আলোচিত রায়ের পরিবর্তে বরং এ সংক্রান্ত প্রতিটি মামলার বিচার ও রায় কার্যকর হওয়া বেশি জরুরি।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নীনা গোস্বামী বেনারকে বলেন “মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়াটা বড় কথা না। ধর্ষণ ঠেকাতে এ সংক্রান্ত প্রতিটি মামলাকে আলোর মুখ দেখাতে হবে। আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে।”

তিনি বলেন, “নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার পরে যদি আপিলে গিয়ে পড়ে থাকে; রায় হলেও তার যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে কিছুদিন পরেই এসব ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাবে।”

“তাছাড়া আমাদের দেশে ধর্ষণের ১০০ মামলার মধ্যে মাত্র তিনটি মামলার রায়ে দোষীদের শাস্তি হয়, বাকি অন্তত ৯৭টি মামলার রায়ই বাদীর পক্ষে আসে না। এটাও আমাদের দেশের আরেকটি বাস্তবতা,” মনে করেন নীনা গোস্বামী।

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার নিন্দা

বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

একে ‘মন্দ সিদ্ধান্ত’ অভিহিত করে এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, “মৃত্যুদণ্ড যৌন সহিংসতার প্রকৃত সমাধান নয়।”

সংস্থাটি বলছে, “মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণসহ কোনো অপরাধ দমন হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং এর ফলে গ্রেপ্তার এড়াতে ধর্ষকরা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের হত্যায় উৎসাহিত হতে পারে।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পক্ষে মত দিয়েছে, যাতে উপেক্ষিত নির্যাতিতাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং আইনী সহায়তায় নিশ্চিত হয়।

এছাড়া ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন পাশ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশলে।

“মূলত মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণ কমাবে বলে যুক্তি দেখানো হলেও কোথাও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, অন্য কোনো শাস্তির পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমিয়েছে। বরং এটাই প্রমাণিত যে, শাস্তির কঠোরতার চাইতে শাস্তির নিশ্চয়তা বিধানই অপরাধ কমায়,” জেনেভা থেকে বৃহস্পতিবার দেওয়া বিবৃতিতে বলেন ব্যাশলে।

তিনি বলেন, “বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই মূল সমস্যাটা হলো যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের প্রথমেই বিচার প্রক্রিয়ায় সুযোগের অভাব।”

উল্লেখ্য, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশে গত ১৩ অক্টোবর সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ।

আইনটির সংশোধিত ৯ এর ১ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

অধ্যাদেশ জারির পর রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের জানান, “আগের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। এখন সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’।

বৃহস্পতিবার আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের সাগর চন্দ্র শীল ও গোপি চন্দ্র শীল, চারালজানি গ্রামের সঞ্জিত চন্দ্র মনিঋষি, সুজন মনিঋষি ও রাজন চন্দ্র।

তিন আসামি পলাতক

টাঙ্গাইলের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নাছিমুল আক্তার জানান, আসামিদের মধ্যে সঞ্জিত ও গোপি রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পরে তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাকি তিন আসামি জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন।

মামলাটির বিষয়ে সরকারি এই কৌঁসুলি জানান, ২০১২ সালে সাগর শীলের সঙ্গে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুরের ওই মাদ্রাসাছাত্রীর মুঠোফোনে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি সাগর ভূঞাপুর গিয়ে ওই ছাত্রীকে কৌশলে মধুপুরে নিয়ে যান। তাঁকে সেখানকার একটি জায়গায় আটকে রাখা হয়।

মামলার তথ্য অনুযায়ী, এর দুদিন পরে ১৭ জানুয়ারি রাতে মধুপুরে বংশাই নদীর তীরে নিয়ে সাগর শীলসহ পাঁচজন মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ফেলে যান। পরদিন সকালে স্থানীয়রা মেয়েটিকে উদ্ধার করেন।

সেদিনই পাঁচজনকে আসামি করে ভূঞাপুর থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী।

মামলা দায়েরের দিনই পুলিশ আসামি সুজনকে গ্রেপ্তার করে। সুজন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। পরে একে একে অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।

তদন্ত শেষে ভূঞাপুর থানার পুলিশ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঘটনার প্রায় তিন বছর পরে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পক্ষ থেকে মামলার বাদীকে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয় বলে সাংবাদিকদের জানান সংস্থাটির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী আতাউর রহমান আজাদ।

তিনি বলেন, “রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি।”

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী গোলাম মোস্তফা মিয়া সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা রায়ে সন্তুষ্ট নন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

কঠোর হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ এ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ ধরনের ঘটনা (ধর্ষণ) রোধ করতে আমাদের ব্যাপক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সব চেয়ে বড় কথা মানুষের মাঝেও জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।