লালমনিরহাটে কোরান অবমাননার অভিযোগে একজনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে

শরীফ খিয়াম
2020.10.29
ঢাকা
201029_BD-mob-attack-Quran_620.jpg বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার পর মারা যাওয়ার আগে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে শহীদুন্নবী জুয়েল। ২৯ অক্টোবর ২০২০।
[ছবি: সৌজন্যে বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান]

লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারীতে মসজিদে ঢুকে কোরান অবমাননার কথিত অভিযোগে বৃহস্পতিবার এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে তাঁর লাশ নৃশংসভাবে পুড়িয়েছে স্থানীয় একদল মানুষ।

জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা বেনারকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি, নিহতের নাম শহীদুন্নবী জুয়েল (৫০)। তিনি একটি কলেজের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। কিছুদিন আগে নিজের চাকরি হারিয়েছেন।”

“ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে,” বলেন তিনি।

তবে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবু সাইদ নেওয়াজ নিশাত বেনারকে বলেন, “এলাকার পরিস্থিতি এখনও থমথমে। যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের বেশ কয়েকজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। যে কারণে পুরো ঘটনাটি আমার কাছে পরিকল্পিত মনে হয়েছে।”

তিনি জানান, নিহত জুয়েল ও তাঁর সহচর সন্ধ্যায় বুড়িমারী স্থলবন্দর কেন্দ্রীয় মসজিদে ঢুকে কোরআন-হাদিসের বই রাখার তাকে অস্ত্র আছে বলে তল্লাশি শুরু করেন বলে অভিযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধরা। পরে তাঁদের মসজিদ থেকে উদ্ধার করে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যান এক ইউপি সদস্য।

অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থলে এসে অভিযুক্তদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করার আশ্বাস দিয়ে সমবেত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।

“এশার নামাজের পর বিক্ষুব্ধ জনতা গ্রিল ভেঙে ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশ করে একজনকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর পিটিয়ে মেরে তাঁকে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়,” বলেন প্রত্যক্ষদর্শী চেয়ারম্যান নিশাত।

অপর অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে গিয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

জীবিত উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির নাম সুলতান জুবায়ের আব্বাস (৫১) উল্লেখ করে এসপি বলেন, “তাদের দুজনের বাড়ি রংপুরের মুন্সীপাড়ায়। তারা এখানে কেন এসেছিল, তা নিয়ে একেক সময় একেক রকম কথা বলছে। যে কারণে মানুষ তাদের সন্দেহ করেছে। অনেকে বলেছে তারা নেশাগ্রস্থ ছিল।”

নিহত জুয়েলের ভাই আবু আক্কাস মো. মেহেদুন্নবী পলাশ বেনারকে বলেন, “ফেসবুকের মাধ্যমেই খবরটি জানতে পারি।”

পলাশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের লাইব্রেরিয়ান পদ থেকে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর জুয়েলকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। আট ভাইবোনের মধ্যে জুয়েল ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান।

“তাঁর সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পেরুনো একটি মেয়ে এবং সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে রয়েছে,” যোগ করেন পলাশ।

ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সাবেক ছাত্র শাহরিয়ার শুভ বেনারকে বলেন, “শান্ত স্বভাবের মানুষ হিসেবেই আমরা তাঁকে চিনতাম। সারাদিন লাইব্রেরিতে থাকতেন। কথা বলতেন কম। প্রচুর বই পড়তেন।”

“তাঁকে নামাজ পড়তে দেখেছি। একসাথে ঈদের নামাজও পরেছি আমরা,” বলেন শুভ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এ ঘটনার দুটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ‘নারায়ে তাকবির- আল্লাহু আকবার’ শ্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত করছে বিক্ষুব্ধ মানুষ। ‘মারো, মারো’ বলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা জুয়েলকে নির্দয়ভাবে লাঠিপেট করছেন অনেকে।

নিথর জুয়েলকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে একজন বলে ওঠেন, “আগুন দিয়ে দাও, আগুন দাও।”

জুয়েলের লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার সময়ও অনেকে মুঠোফোনে সে দৃশ্য ধারণ করছিলেন।

এ ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্খিত’ উল্লেখ করে নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ বেনারকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই দেখা যাচ্ছে, একটি বিশেষ চক্র ধর্মীয় উন্মাদনা ব্যবহার করে বারবার অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করছে। অথচ ধর্মের মর্মবাণীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

“বিভিন্ন গোষ্ঠীকে যার যার ‘হিডেন এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিচ্ছে এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি। এই রকম পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রশাসনের সচেতনতা যেমন দরকার, একইভাবে রাজনৈতিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের ঘটনাগেুলো অবশ্যই সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যহত করে.” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।