মানবাধিকার প্রতিবেদন: বাংলাদেশে নারী নির্যাতন মামলায় খুব অল্প সাজা হয়

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.11.04
ঢাকা
BD-women-violence-acid620.JPG ঢাকায় নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রচারণা সমাবেশে একজন এসিডদগ্ধ নারী। ২৪ নভেম্বর ২০১০।
[রয়টার্স]

করোনাভাইরাস মহামারিকালে বাংলাদেশের নারী ও মেয়ে শিশু আরও বেশি মাত্রায় সহিংসতার শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

সংস্থাটি বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রণয়ন হলেও এসব আইনে দায়ের করা মামলার মাত্র অল্প ক্ষেত্রে দোষীদের সাজা হয়।

এদিকে সাজা কম হওয়ার নানা কারণের কথা উল্লেখ করে আইন দুটি খুবই কার্যকর বলে মত দিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সরকার পরিচালিত মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির প্রধান ড. আবুল হোসেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে নারীদের অধিকার রক্ষায় আইন দুটি অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে, এই আইন দুটি কার্যকর হচ্ছে না। আসলে কথাটা ঠিক নয়।”

“বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, যারা নির্যাতিত হন তাঁরা মামলা করতে চান না। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো, মানুষ সালিসের মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যা মেটাতে চান। এ দেশের মেয়েরা নির্যাতন মেনে নিয়ে সংসারের দিকে তাকিয়ে এবং সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সংসার টিকিয়ে রাখেন,” জানান সরকারের ওই কর্মকর্তা।

ড. আবুল হোসেন আরও বলেন, “আবার নির্যাতিতা নারীদের একটি বড় অংশ দরিদ্র। তাঁরা মামলা করার মতো ক্ষমতা অথবা সাহস রাখেন না। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্যাতনকারীরা অর্থবান অথবা ক্ষমতাবান হন। এসব কথা বিবেচনা করে নির্যাতিত নারী অথবা তাঁর পরিবারের সদস্যরা মামলা করা থেকে বিরত থাকেন।”

প্রয়োজন প্রতিবন্ধকতা দূর করা

গত ২৮ অক্টোবর এইচআরডব্লিউ এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সরকারের জাতীয় পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশের প্রাক্কালে এই নির্যাতন বৃদ্ধির ঘটনাগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এই প্রবণতা বাংলাদেশে নারী নির্যাতন রোধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, সুরক্ষা এবং সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিগত বাধাগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, "কোভিড-১৯ মহামারির সময় নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতার ঊর্ধ্বগতি এবং যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক প্রতিবাদ সমাবেশ সরকারের কাছে একটি ঘণ্টা বেজে ওঠার মতো ঘটনা। এর মাধ্যমে জরুরি কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে।"

অবশ্য আবুল হোসেনের মতে, “কোনো নারী অথবা শিশু নির্যাতনের শিকার হলে আমরা আমাদের বিভিন্ন জেলা ‍ও বিভাগে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠিয়ে দিই। সেখানে তাঁদের চিকিৎসা ও সুরক্ষা দেওয়া হয়। তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়া হয়।”

“কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মামলা করার পর ভুক্তভোগীরা আসামিপক্ষের সাথে আপস করে ফেলেন, মামলা প্রত্যাহার করে নেন। আবার মামলা চললেও দেখা যায় সাক্ষী পাওয়া যায় না। এত কিছুর পরও যাঁরা শেষ পর্যন্ত সাহসের সাথে মামলা চালিয়ে যান তাঁরা বিচার পেয়ে থাকেন,” মত দেন আবুল হোসেন।

এইচআরডব্লিউ বলছে, সরকারের উচিত দেশজুড়ে সুলভ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা, আইনি সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং সহিংসতার প্রতিবেদন ও ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা।

একজন মহিলা আইনজীবীকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “সমাজে পারিবারিক সহিংসতাকে তুচ্ছ সহিংসতা বলে মনে করা হয়। বিষয়টি এমন যে এ ধরনের ঘটনা পরিবারে ঘটেই থাকে।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “নির্যাতিতা নারীরা বিচার পেতে থানায় গেলে পুলিশের কাছ থেকে অনেক সময় সহযোগিতা পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আবার মামলা নিলেও মামলা তদন্তে অনীহা অথবা গাফিলতি দেখান।”

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “আমি নিজে দেখেছি, সিলেট অঞ্চলে একজন ধর্ষণের শিকার নারীকে সকাল থেকে রাত অবধি থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার উচিত ছিল ওই নারীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পাঠিয়ে তাঁর মেডিকেল পরীক্ষা করা। কারণ ধর্ষণের পর যদি কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় তাহলে তো ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যাবে।”

পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পর্কে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো, সব জায়গায় কিছু খারাপ মানুষ থাকে। সুতরাং, পুলিশের মধ্যেও কিছু খারাপ মানুষ আছে। তাঁদের মধ্যে নৈতিক স্খলন আছে। কিন্তু এটি দেশের সার্বিক চিত্রের প্রতিফলন নয়।”

তিনি বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনের আওতায় যত মামলা হয় তার শতকরা ২৫ ভাগ মিথ্যা মামলা। দেখা যায়, জমিজমার বিরোধ, পারিবারিক শত্রুতা, অথবা অন্য কোনো কারণে আরেকজনকে ফাঁসাতে অনেকেই নারী নির্যাতনের মামলা করেন। ফলে মামলা নিতে পুলিশ একটু সময় নেয়।”

শহিদুল হক বলেন, “এর অন্যতম কারণ হলো, এই আইনে দায়ের করা মামলা অজামিনযোগ্য। সে জন্য পুলিশ প্রাথমিকভাবে মামলা করার যৌক্তিকতা খুঁজে দেখে। যদি দেখে অভিযোগে সত্যতা আছে তখন মামলা নেয়। তবে, কোনো নারী আহত হয়ে থানায় মামলা করতে আসলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে।”

তিনি বলেন, “তবে ছোটখাটো অভিযোগের মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করে পুলিশ। এর কারণ হলো, মামলা নিলে তো সংসার ভেঙে যাবে। এ কারণে পুলিশ চায় মিটমাট করে হলেও সংসার টিকে থাকুক। আর যদি ঢালাও মামলা গ্রহণ করা হয় তাহলে দেশে মামলার জট আরও বেড়ে যাবে।”

পুলিশের মামলা, তদন্ত ও বিচার নিয়ে এসব যুক্তি–পাল্টা যুক্তির পাশাপাশি বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারী ও মেয়ে শিশু নানা ধরনের লৈঙ্গিক সহিংসতার শিকার।

‘বেশিরভাগ মামলা ঝুলে থাকে’

২০১৫ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত নারী তাঁদের সঙ্গীদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ও মাত্রার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী বলেছেন, সঙ্গীরা তাঁদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলেও তাঁরা কখনোই কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। তিন শতাংশেরও কম ভুক্তভোগী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে কমপক্ষে ২৩৫ জন নারীকে তাঁদের স্বামী বা স্বামীর পরিবার হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংগঠনটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সরকার পরিচালিত মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির আওতায় নারীর জন্য সরকারের নয়টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার রয়েছে।

এর কোনো একটি সেন্টারের মাধ্যমে দায়ের করা ১১ হাজারের বেশি মামলার মধ্যে কেবল ১৬০টি ঘটনায় সফলভাবে দণ্ডাদেশ এসেছে।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, হিউম্যান রাইটস প্রতিবেদন মোটামুটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে।

ঢাকা বারের সদস্য প্রকাশ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “নারী নির্যাতন ঠেকাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০০০ পাশ করে সরকার। এই আইন দুটি পাশের উদ্দেশ্য মহত। কিন্তু এর প্রয়োগে পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থার সব জায়গায় অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যাচ্ছে।”

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “নারী নির্যাতন দমন আইনের বিধান অনুযায়ী, এই আইনে দায়ের করা মামলার বিচার বিচারিক আদালতে ছয় মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। যদি বিচার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা না যায় তাহলে উচ্চ আদালতকে এ ব্যাপারে লিখিতভাবে জানাতে হবে। কিন্তু ছয় মাসে মামলাও শেষ হয় না, আবার উচ্চ আদালতকে জানানো হয় না।”

প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, “দেখা যায়, একটি জেলায় নারী নির্যাতনের মামলার সংখ্যা কয়েক হাজার। কিন্তু বিচারক একজন। একজন বিচারকের পক্ষে এত মামলা শেষ করা সম্ভব নয়। আবার দেখা যায়, পুলিশ সময়মতো প্রতিবেদন দেয় না। আসামি আদালতে হাজির করে না। তারিখ পেছাতে থাকে। সাক্ষী আসে না। এসব কারণে বেশিরভাগ মামলা ঝুলে থাকে অথবা সাজা হয় না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।