অ্যামনেস্টি প্রতিবেদন: বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যা ৪৬৬

শরীফ খিয়াম
2019.11.04
ঢাকা
191104_BD_Amnesty_crossfire_1000.JPG ঢাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের হাতে আটক কয়েকজন। ২৮ মে ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের মাদকবিরোধী যুদ্ধে ৪৬৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন বলে সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদের শেষ বছরে ২০১৮ সালের ৩ মে  মাদক প্রতিরোধে ওই যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বলেও দাবি করেছে অ্যামনেস্টি।

তবে “নিহতরা অভিযান চলাকালে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে,” মন্তব্য করে এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ বেনারকে বলেন, “এই ধরনের হতাহতের ঘটনাগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলা ঠিক না। এতে বোঝায় আমরা বিচার ছাড়াই মেরে ফেলছি, কিন্তু আসলে পরিস্থিতি ভিন্ন।”

অন্যদিকে প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক দিনুশিকা দিশানায়েক বলেন, “মাদক বিরোধী যুদ্ধে গড়ে প্রতিদিন অন্তত একজন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।”

বিশেষত র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র‍্যাব) সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোয় আইন মানা হয়নি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, বিচারের সম্মুখীনও করা হয়নি।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণার প্রথম ১০ দিনের মধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অন্তত ৫২ জন নিহত হন। সবমিলিয়ে ২০১৮ সালে দেশজুড়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৬৬ জন, যা ২০১৭ সালের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি।

বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরাও এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৮ সালে বিচারবহির্ভুত হত্যার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।”

“মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ প্রকাশের ফলে এখন এর হার কিছুটা কমে এলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি,” বলেন তিনি।

তবে “পৃথিবীর কোনো দেশেই খুব শান্তিপূর্ণভাবে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা যায়নি। কারণ এটা খুবই ‘ভায়োলেন্ট-টাইপের ট্রেড’ (সহিংসপূর্ণ ব্যবসা)। মাদক কারবারীদের কাছেও প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র থাকে,” বলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ফরহাদ।

দিনুশিকা দিশানায়েক জানান, মাদক প্রতিরোধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষেরা অত্যন্ত আতঙ্কিত। মফস্বলের দরিদ্র বাসিন্দারা ভয়ে আছেন যে, মাদকের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসাজশ মিললেই তাঁদের প্রিয়জনদের বিচারবহির্ভূতভাবে মেরে ফেলা হবে।

“বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে,” বলেন তিনি।

এদিকে রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে “সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে,” বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভুয়া প্রমাণ গুম

‘ক্রসফায়ারে হত্যা: মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অভিযোগ’ শিরোনামে প্রকাশিত ২৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে নিহতদের নামে ভুয়া প্রমাণ তৈরিরও অভিযোগ এনেছে অ্যামনেস্টি।

সাধারণত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে উল্লেখ করে তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীগুলো নিয়মিতভাবে এটাকে দুই পক্ষের গুলি বিনিময়ে মৃত্যু দাবি করে আসছে। ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখতে যথাযথ তদন্ত শুরুর বদলে তারা নিজেদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য ভুয়া প্রমাণ তৈরি করছে।

অ্যামনেস্টিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব হত্যাকাণ্ডের কথিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাঁদের চোখের সামনে কিছু ঘটেনি। এমন পাঁচজন কথিত প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, তাঁদেরকে জোর করে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিবৃতি দিতে নিরাপত্তা বাহিনীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেননি তাঁরা।

তাঁরা জানান, রাজি না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা ছিল তাঁদের।

তবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দাবি, “কোনোভাবেই বলা যাবে না সরকার কাউকে ধরে এনে মেরে ফেলছে, আর সেটাকে হালাল করার জন্য নাটক সাজাচ্ছে। কারণ আমরা এখনো এর কোনো প্রমাণ, নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে পাইনি।”

অন্যদিকে প্রতিবেদনে বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগও তুলে বলা হয়েছে, কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সকল ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কারের কয়েকদিন আগে তাঁদের জোরপূর্বকভাবে গুম করা হয়েছে। কারো কারো ক্ষেত্রে হত্যার ছয় সপ্তাহ আগেও গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাতটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজির কথাও জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।

এর আগে গত শুক্রবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের বিচারপ্রক্রিয়া সফলভাবে শেষ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সাফল্যকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

তদন্তের দাবি

মাদককিরোধী অভিযানে পুলিশ ও র‍্যাবের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যাচাইয়ে নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও কার্যকরী তদন্ত চালুর আহবান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি।

আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজাও বলেন, “আমরা খুব উদ্বিগ্ন। কারণ এখন পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি।”

তবে ব্যারিস্টার ফরহাদের মতে, “এই ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনাই তদন্ত হয়। আমাদের আইনেই বলা রয়েছে, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কোথাও গুলি চালালে, সেখানে যদি কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটে, তবে বাধ্যতামূলকভাবে তদন্ত করতে হবে।”

এছাড়া “কোনো পরিবার যদি মনে করে, তাঁদের পরিবারের সদস্যকে বেআইনিভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, তাহলে তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন। বাংলাদেশের আইনে প্রত্যেক নাগরিককে সেই অধিকার দেওয়া আছে,” যোগ করেন ব্যারিস্টার ফরহাদ।

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।