রোহিঙ্গা শিবিরে দুই সপ্তাহে তিন শীর্ষ আরসা নেতা গ্রেপ্তার
2022.07.18
কক্সবাজার
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে অভিযান চালিয়ে গত দুই সপ্তাহে মিয়ানমারের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ফতোয়া কমিটির চেয়ারম্যান এবং সংগঠনটির একজন কমান্ডারসহ শীর্ষ তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন)।
এদের মধ্যে গত রোববার ভোরে উখিয়ার ৭ নম্বর রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় ড্রোন ক্যামেরার সাহায্য নিয়ে আরসা’র গান কমান্ডার সৈয়দুল আমিনকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া উখিয়ার বালুখালী ৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবির থেকে আরসার ওই ক্যাম্পের জিম্মাদার আবু বক্কর (৩৭) ওরফে জমির হোসেন ওরফে হাফেজ মনিরকে একটি দেশীয় তৈরি একনলা বন্দুক ও ১৫ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক করা হয়। সৈয়দুল আমিন উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৭) জি ব্লকের রোহিঙ্গা আমির হোসেনের ছেলে।
এর আগে গত ৭ জুলাই আরসার ফতোয়া কমিটির চেয়ারম্যান ও ৭ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদকে (৪৮) আটক করা হয় বলে জানান ১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক মো. নাইমুল হক।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সৈয়দুল আমিন, আবু বক্কর ও নূর মোহাম্মদকে গ্রেফতার করেছে এপিবিএন। ওই তিনজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
“সৈয়দুল ও আবু বক্করকে সোমবার দুপুরে আদালতে পাঠানো হলে বিচারক তাদের জেলে পাঠান,” ওসি জানান। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিগগিরই এই দুই জনের রিমান্ড চাওয়া হবে।
নাইমুল বেনারকে জানান, নূর মোহাম্মদ ছিলেন কথিত আরসা’র ফতোয়া কমিটির চেয়ারম্যান। রাতে আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতেন তিনি। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সময় মাওলানার বেশে চলতেন যাতে করে সহজে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সৈয়দুল আমিন ছিলেন ক্যাম্প-৭ এর গান কমান্ডার এবং বিভিন্ন সময়ে সদস্যদের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি।
নাইমুল আরও জানান,সৈয়দুলের কাছে জি-থ্রি রাইফেলের মত ভারী অস্ত্র রয়েছে এবং ইতিমধ্যে জি-থ্রি রাইফেলসহ সৈয়দুলের তোলা ছবিও উদ্ধার করা হয়েছে।
ড্রোন চালিয়ে অবস্থান নিশ্চিত করে সৈয়দুলকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে নাইমুল আরও বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈয়দুল স্বীকার করেছেন যে, দীর্ঘ ছয় মাস তিনি মিয়ানমারের গহিন অরণ্যে তথাকথিত আরসা গ্রুপের তত্ত্বাবধানে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।”
নাইমুল জানান, সম্প্রতি সৈয়দুল আমিন নাফ নদী অতিক্রম করে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বালুখালী ৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে কথিত আরসার ‘জিম্মাদার’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন আবু বক্কর। তিনি একেক সময় একেক নাম ব্যবহার করতেন বলে জানান ৮ এপিবিএন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন।
তিনি বেনারকে বলেন, আবু বক্কর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ অপরাধী। বালুখালী ৮ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে কথিত আরসার জিম্মাদার হিসাবে সে পরিচিত।
“২০২১ সালের অক্টোবর ময়নারঘোনা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৮) একটি মাদ্রাসা ও এর সংলগ্ন মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয় রোহিঙ্গা শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে হত্যা এবং সম্প্রতি উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মাঝি আজিমুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় আবু বক্কর জড়িত ছিলেন,” জানান কামরান।
৬ মাসে ৮৩৬ জন আরসা নামধারী আটক
রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক নাইমুল বেনারকে জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে তাদের কর্ম এলাকা থেকে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির ভাই শাহ আলী, আরসার গান কমান্ডার সৈয়দুল, ফতোয়া কমিটির চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদসহ সহ গত ছয় মাসে ৮৩৬জন আরসা নামধারী সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে।
এ সময় তিনটি বিদেশি পিস্তলসহ অন্তত ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গাকে আটকের কথা জানিয়ে নাইমুল হক বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে শিবিরগুলোতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এখন নিয়মিতভাবে বিশেষ করে ভোর রাতে ড্রোন ব্যবহার করে নজরদারির মাধ্যমে অভিযান চালানো হচ্ছে।
শিবিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতংক
উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে একের পর এক খুন, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে আতংকিত হয়ে পড়ছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও তাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর এ সমস্যা প্রকট হয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও কমিউনিটি নেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উখিয়ার ১ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের এক নেতা বেনারকে বলেন, আরসা সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ অপরাধ জগত এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।
“তাঁরা চায় এসব অপরাধের মাধ্যমে টাকা আয় করে বাংলাদেশে থাকতে। আর কেউ প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বললেই তাকে তারা টার্গেট করে। এ জন্য ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলে না,” বলেন তিনি।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসীদের উৎপাত কিছুটা কমেছে জানিয়ে আরেক রোহিঙ্গা নেতা বেনারকে বলেন, পুরো ক্যাম্পজুড়ে হিসাব করলে দেখা যাবে খারাপ মানুষের সংখ্যা এতো বেশি নেই। কিন্তু ভারী অস্ত্র থাকায় তাদের কাছে সাধারণ রোহিঙ্গারা অসহায়।
উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বেনারকে বলেন, “একের পর এক খুন, গুমসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে আমরা স্থানীয়রা রীতিমত আতংকে আছি। রোহিঙ্গাদের অপরাধ দমনে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে এখানে স্থানীয়দের বসবাস করাটাই কঠিন হয়ে পড়বে।”
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে যেভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা জানি না এসবের শেষ কোথায়, সমাধান কী।”
তিনি বলেন, উখিয়া-টেকনাফে বর্তমানে ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের মধ্যে আরসা বা বিভিন্ন গ্রুপের সন্ত্রাসীদের সংখ্যা খুবই কম।