রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত: ফরটিফাই রাইটস
2018.08.28
এক বছর আগে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে তাঁদের মিয়ানমারের বাসভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। খুন হয়েছিল নারী–শিশুসহ ৬ হাজার ৭০০ নিরপরাধ মানুষ। রাখাইনের সাড়ে তিনশরও বেশি গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি। গত ২৫ আগস্ট এক বছর পূর্তিতে এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। এগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটসের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে স্পষ্ট বোঝা যায়, রোহিঙ্গাদের ওপর ওই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। আর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ছিল এই পরিকল্পনার রূপকার। ফরটিফাই রাইটসের এই প্রতিবেদনটি জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটি কয়েকদিন আগে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গণহত্যার উপাদান পাওয়া গেছে বলে তারা ওই প্রতিবেদনে জানিয়েছে। তারা উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উপস্থাপনের সুপারিশ করেছে।
সহিংসতা বন্ধে ব্যর্থ হওয়া এবং একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে সেনা কর্মকর্তাদের বর্বরতাকে গোপন করার কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সাং সু কির ভূমিকার সমালোচনা করেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। আরও লেখা হয়েছে অস্থায়ী শিবিরগুলোয় বর্ষা মৌসুমে কীভাবে রোহিঙ্গারা ভুগছে তা নিয়েও।
তবে আলোচনার বাইরে থেকে গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর কি করল সেই ইস্যুটি। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পক্ষে এই একটি ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে বরাবর দাঁড় করানো হচ্ছে।
আরসা বরাবর বলে আসছে, আন্তর্জাতিক আইনে আত্মরক্ষার চেষ্টা করা অন্যায় কিছু নয়। তারা শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেই রক্ষা করতে চেয়েছে, যেন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। নাগরিকত্ব পেলেই তারা অন্যসব নাগরিকদের মতো আইনি অধিকার ও সুরক্ষা পাবে। আরসা সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগসূত্র কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদের ভূমিকা নেয়নি।
অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য ও ৩০টি সীমান্ত চৌকিতে হামলা আরসা কোন ভাবনা থেকে করেছিল? ২০১৬ সালের অক্টোবরে একই ধরনের হামলা চালিয়ে ছয়জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে এমনিতেই তারা সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়েছিল। সেনাবাহিনী তখন থেকেই রাখাইনে সেনা সমাবেশ ও সমরাস্ত্র বাড়াতে থাকে। একই সঙ্গে আধাসামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে।
আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়েছিল। এই সেনাবাহিনী গেল ৭০ বছর ধরে মিয়ানমারের কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে পোড়ামাটি নীতি বাস্তবায়নে কাজ করছে। তাতমাদাও কখনও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসবাদ দমনে কাজ করেনি। কখনও সুশাসন বা উন্নয়ন দিয়ে জনগণের হৃদয় জয় করারও চেষ্টা করেনি। জাতিসংঘ প্যানেল অবশ্য মনে করে, নিরাপত্তার নামে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিলো '' চরমভাবাপন্ন এবং প্রকৃত নিরাপত্তা ঝুঁকির তুলনায় অসম''।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশ প্রান্তিক কৃষক। ২০১৫ সালের পর থেকে তারা ধারাবাহিকভাবে জাতিগত হামলা ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ছিল। তাদের কেউ কেউ সশস্ত্র সংগ্রাম শুধু ঝুঁকি বাড়াবে বলেই আশঙ্কা করে।
তবে উগ্রবাদী দলটি নিজেদের রক্ষাকর্তা মনে করতে শুরু করেছিল।
বাস্তুচ্যুত হওয়ার এক বছর পর আরসা একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে তারা মিয়ানমার সরকারকে গণহত্যাকারী সেনা শাসক বলে অভিহিত করেছে এবং আত্মরক্ষার অধিকার তাদের আছে বলে আবারও জানিয়েছে।
“আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, পূর্বপুরুষের ভিটে ফিরে পেতে এবং বার্মার সন্ত্রাসী সরকার ও গণহত্যাকারী সেনাবাহিনীর হাতে নিহতদের জন্য বিচার চাইতে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাব,” ওই বিবৃতিতে বলা হয়।
বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের সুরক্ষায় আরসা কিছুই করেনি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আরসা মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়, কিন্তু নতুন করে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আর তাদের নেই।
আরসা যেন কোনোভাবেই প্রবেশ করতে না পারে সে লক্ষ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও সীমান্তকে আরও সুরক্ষিত করেছে, স্থলমাইন পুঁতেছে এবং সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত কিছু অভিযান ছাড়া প্রকৃতপক্ষে ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী কোনো অবস্থান নেই আরসার।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আরসা রাখাইনের উত্তরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ছয়জন সৈন্যকে আহত করে। গত বছরের আগস্টের পর এই প্রথম আরসা আবার কোনো হামলা চালালো এবং তারপর তাদের আর কোনো উপস্থিতি চোখে পড়েনি।
আরসার প্রধান উদ্দেশ্য এখন শরণার্থী শিবিরের ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করা। ধারাবাহিকভাবে শিবিরের ভেতরে কমপক্ষে ২১ জন স্থানীয় নেতা খুন হয়েছেন। তাঁরা আরসার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং রোহিঙ্গাদের এই দুর্গতির জন্য আরসাকে দায়ী করতেন।
আরসা বিরোধী অংশটি এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আরসার ১৫ সদস্যকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। আরসা এর প্রতিশোধ নিয়েছে।
প্রতিপক্ষকে হত্যা করে অথবা চুপ করিয়ে দিয়ে, আরসা এখন উগ্রবাদে দীক্ষা দেওয়া ও দলে লোক ভেড়ানোর কাজে ব্যস্ত। বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির যেখানে যৌন হয়রানি, অনিরাপত্তা, খাদ্যাভাব ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট রয়েছে সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীতে যুক্ত হওয়া অনেকের কাছেই যৌক্তিক। কারণ তারা মনে করছে, এতে নিরাপত্তা ও বাড়তি সম্পদ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের হাতে যেন কোনোভাবেই অস্ত্র না যায় সে ব্যাপারে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ খুবই শক্ত অবস্থানে আছে এবং তারা আরসার একজন নেতাকে গ্রেপ্তারও করেছে।
এমনকি আরসা যে প্রচারণা চালাচ্ছিল সেটিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই সময়ে তাদের কাজ কিছু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।
আরসা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ঢাকা ও নেপিডোর মধ্যে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে এ বছরের জানুয়ারিতে একটি চুক্তি হয়েছিল। এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে চাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা খুবই কম। তাঁরা আগে আইনী সুরক্ষা চায়। আশংকা করা হচ্ছে, আরসা হয়তো শরণার্থী শিবিরের মানুষগুলোর দুঃখকে পুঁজি করে এগোতে পারে।
তাতমাদাও বরাবরই সন্ত্রাসবাদ দমনকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করে আসছে। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া তারা এইচএওয়াই–কে (আরসার সাবেক নাম) আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী বলে আখ্যা দিচ্ছে এবং বলছে আরসা ইসলামিক স্টেট গঠন করতে চায়। মিয়ানমার সরকার গত বছরের অক্টোবরে আরসাকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে আখ্যা দিয়েছে।
মিয়ানমার সরকার তাদের অবস্থানে আরও দৃঢ় হয় যখন আল কায়েদা গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিবৃতি দেয়। এর পরপরই একই ধরনের বার্তা আসে ইসলামিক স্টেট সমর্থিত সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে। যদিও রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো দলই কিছু করেনি।
সিঙ্গাপুরে সু কি তাঁর সাম্প্রতিক বক্তৃতায় তাতমাদাও এর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, আরসার বিরুদ্ধে অবস্থান এই অঞ্চলকে আরও নিরাপদ করবে।
“সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যার জবাবে মানবিক সংকট তৈরির মতো ঘটনা রাখাইনে ঘটেছে, সে ধরনের কর্মকান্ডের আশংকা সত্য এবং এখনও বর্তমান। এই নিরাপত্তা ঝুঁকি যদি বিবেচনায় না নেওয়া হয় তাহলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অব্যাহত থাকবে। এটা একটা মারাত্মক হুমকি এবং শুধু মিয়ানমারের জন্যই নয় বরং এই অঞ্চল ও অঞ্চলের বাইরের জন্যও।
তবে সমস্যাটা হলো যতদিন এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে ততদিনই মানুষ আরও বেপরোয়া কান্ড ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হবে। মালয়েশিয়ার বিশেষ শাখা ইতিমধ্যে এই উদ্বেগের বিষয়টি উল্লেখ করেছে। তারা ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গ টেনে সতর্ক করেছে, “এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সালাফি জিহাদি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে, তারা জঙ্গিগোষ্ঠীতে নাম লেখাবে এবং রাখাইনে যাবে তথাকথিত জিহাদের নামে।”
আরসা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এ বছরের ২৯ জুলাই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা আবারও জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট অথবা লস্কর ই তৈয়বার কোনো যোগাযোগ নেই।
“আমরা আরাকানে বিপ্লবের জন্য এই গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন চাই না,” ওই বিবৃতিতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, তারা আরসার সঙ্গে যুক্ত হতে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় এবং সন্ত্রাসবিরোধী যেকোনো কাজে রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের যেমন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ হওয়ার শংকা রয়ে গেছে। মালয়েশিয়া এক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং এ ধরনের হুমকি সম্পর্কে অবহিত আছে। দেশটি নিজ দেশের এবং তৃতীয় আরেকটি দেশের নাগরিককে রাখাইনে সংগ্রাম করতে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার করেছে।
এই সমস্যার সমাধান খুব সহজে হচ্ছে না। আরসা ও মিয়ামনার সরকার—উভয়ই নিজ নিজ অবস্থানে কঠোর। এ পরিস্থিতি জঙ্গিবাদকে উস্কে দিতেই পারে। এতে করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, রোহিঙ্গাদের জন্যও মঙ্গলজনক কিছু হবে না।
( যাকারি আবুজা ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক এবং “Forging Peace in Southeast Asia: Insurgencies, Peace Processes, and Reconciliation.” গ্রন্থের লেখক। এই নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব এবং কোনোভাবেই তা ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স, দ্য ন্যাশনাল ওয়ার কলেজ বা বেনারনিউজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়। )
অনুবাদ: প্রাপ্তি রহমান