এশিয়াজুড়ে বাড়ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ
2024.11.01
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসানের জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক দিবস চালু করার পর এক দশকে সারা বিশ্বে প্রায় ৮০০ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। আরো অনেকে সহিংসতা, হুমকি, হয়রানি এবং মামলার শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা রয়ে গেছে বিচারের বাইরে।
মিয়ানমারের মতো গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশে সাংবাদিকরা ক্রসফায়ারের ফাঁদে পড়েছেন। দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এ অবস্থা সত্য। চীন বিশ্বের বৃহত্তম সাংবাদিক কারাগার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই সপ্তাহে একজন ব্লগারকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ভিয়েতনাম।
বুধবার প্রকাশিত কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের বার্ষিক বৈশ্বিক দায়মুক্তি সূচকে এশিয়ার অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। সাংবাদিক হত্যায় বিচারহীন দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইন নবম এবং মিয়ানমার দশম স্থানে রয়েছে।
গত এক বছরে কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, কারা নির্যাতন, অপহরণ বা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, এমন কিছু ঘটনার প্রতিবেদন করেছে বেনারনিউজ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়া। এই দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে এমন কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়েই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ
জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে গণআন্দোলন সহিংস রূপ নিলে অন্তত পাঁচ সাংবাদিক নিহত এবং অনেকে আহত হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহত হন বেনারের ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ। পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর শরীর থেকে দুটি প্যালেট বের করা হয়।
এ ছাড়া বিক্ষোভকারীদের মারধরের শিকার হন বেনারনিউজের প্রতিবেদক শরীফ খিয়াম আহমেদ। তাঁর মাথায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়।
এমনকি দেশের বাইরে অবস্থানকারীরাও সাংবাদিকতার জন্য অনলাইনে ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ওয়াশিংটনের বার্তাকক্ষ থেকে বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে সরাসরি সম্প্রচারের পর আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে সুপরিচিত নিঝুম মজুমদারের টার্গেটে পরিণত হন বেনারের সাংবাদিক আশীফ এন্তাজ রবি।
ফেসবুকে নিঝুম মজুমদারের ফলোয়ারের সংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি। রবির নাম ও ছবিসহ তাঁকে অভিযুক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট দেন নিঝুম। পৃথক একটি ভিডিওতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দ্বারা নিয়োজিত হয়ে ভুয়া খবর প্রচারের জন্য রবিকে অভিযুক্ত করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে “সরকার উৎখাত করার” জন্য মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত চক্রান্তের অংশ হিসেবে গুজব ছড়াতে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই এসব পোস্ট অদৃশ্য হয়ে যায়।
ভিয়েতনাম
অক্টোবর ৩০: হ্যানয়ে সাংবাদিক ডুয়ং ভ্যান থাইকে (৪২) “রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচারণার” দায়ে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একটি অস্পষ্ট আইনে রুদ্ধদ্বার আদালতে তাঁর বিচার করা হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, ভিয়েতনামে প্রায়ই ভিন্নমত দমনের জন্য এই আইন ব্যবহার করা হয়।
ব্লগার ও ইউটিউবার ডুয়ং ২০১৯ সালে পালিয়ে গিয়ে থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্যাংককে থাকা অবস্থায় নিজের বাসা থেকে তিনি নিখোঁজ হন। এর প্রায় ১৮ মাস পরে তাঁর বিচার শুরু করা হয়। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ডুয়ং থাইকে অপহরণে ভিয়েতনাম এবং ব্যাংকক উভয় দেশেই দায়ী।
মিয়ানমার
এ বছরের ২১ আগস্ট মিয়ানমারের সোম রাজ্যে জান্তা সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন দুই সাংবাদিক– টেট মায়াট থু (২৮) এবং উইন টুট ওও (২৬)। বিপ্লবী বাহিনী সেখানে অবস্থান করছে খবর পেয়ে সৈন্যরা কেয়াখোট শহরে টেট মায়াট থু’র বাড়িতে অভিযান চালিয়ে এই দুই সাংবাদিককে হত্যা করে। জান্তা বাহিনী দুই সাংবাদিকের লাশ পরিবারের কাছে ফেরত না দিয়ে দাহ করে।
মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে কমপক্ষে পাঁচ সাংবাদিক নিহত এবং ১৭০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার হন।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার জয়পুরায় বেনারের সংবাদদাতা ভিক্টর মাম্বর। তিনি পাপুয়াভিত্তিক গণমাধ্যম ‘জুবি’তেও কাজ করেন। গত অক্টোবরের শুরুতে জুবি কার্যালয়ে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে সেখানে পার্ক করা দুটি গাড়িতে আগুন লাগে।
জুবি ইন্দোনেশিয়ার অশান্ত এবং সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পাপুয়া অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর প্রকাশ করে থাকে।
এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মাম্বরের বাসভবনের বাইরে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয় এবং ২০২১ সালের এপ্রিলে তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু এজন্য কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
চীন
২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে নানজিংয়ে ভিন্নমতের সাংবাদিক সান লিনের (৭২) বাড়িতে প্রবেশ করে পুলিশ। প্রতিবেশীরা সেখানে সংঘর্ষের শব্দ পান। পরে পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সন্ধ্যার মধ্যে সান লিনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছে প্রবাসী ‘চায়না মানবাধিকার রক্ষাকারী নেটওয়ার্ক’।
জি মু ছদ্ম নামে পরিচিত সান লিন তাঁর সামাজিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত সংবাদের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর কাজ এবং স্পষ্টভাষী লেখালেখির জন্য তিনি দুইবার চার বছরের কারাদণ্ড ভোগ করেন।
পুলিশের দাবি, সান লিন তাদের উপর আক্রমণ করায় তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ৭০ বছর বয়স্ক একজন মানুষ কীভাবে একদল জোয়ান পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে পারে-সে প্রশ্ন উঠেছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) চলতি বছরের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে চীনকে ১৭২তম স্থানে রেখেছে। তারা দেশটিকে, "সাংবাদিকদের জন্য বৃহত্তম কারাগার" হিসেবে অভিহিত করেছে।
উইঘুর
চীনের পশ্চিম জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুরদের দমন এতটাই সামগ্রিক যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো সাংবাদিক সেখানে কাজ করে না। উইঘুর মুসলিমরা চীনের জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ হলেও আরএসএফ-এর তথ্য মতে, দেশটিতে বন্দি প্রায় অর্ধেক সাংবাদিক এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
এই অঞ্চলে চীনা কর্তৃপক্ষের দমন-পীড়ন এতটাই চরম যে, দেশের বাইরে থেকে তাদের সম্পর্কে জানতে প্রায়ই কয়েক বছর সময় লাগে। মে মাসে ভয়েস অফ আমেরিকার সাংবাদিক কাসিম কাশগার জানতে পেরেছিলেন তাঁর সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তাঁর পাঁচজন প্রাক্তন সহকর্মীকে ২০২১ সালে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
২০১৮ সালে প্রকাশক এরকিন এমেট গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা জানা গেছে এ বছরের মার্চে। কুরবান মামুত একজন প্রভাবশালী উইঘুর সম্পাদক এবং রেডিও ফ্রি এশিয়ার সাংবাদিক বাহরাম সিনতাশের পিতা। তিনি ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হন।
সিন্তাশ বলেছিলেন, প্রভাবশালী ম্যাগাজিন জিনজিয়াং সিভিলাইজেশন সম্পাদনা করায় তাঁর বাবাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার কারণ।
কম্বোডিয়া
সামিয়াং হট নিউজ নামে একটি ছোট অনলাইন ওয়েবসাইট চালান সাংবাদিক লুন ফেরিন। গত ২ মার্চ পোয়েপেটের একটি স্থান থেকে অবৈধ জুয়া খেলার খবর লাইভস্ট্রিম করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সাথে সাথে একদল লোক লাঠি ও ঢিল দিয়ে তাঁদের আক্রমণ শুরু করে।
এজন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তবে ফারিন এবং তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে জুয়ার জায়গায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা করেছে সেটির মালিক।
হংকং
গত সেপ্টেম্বরে বিশিষ্ট সাংবাদিক চুং পুই-কুয়েনকে ২১ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চীনের কাছে হংকং হস্তান্তরের পর রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে কারাগারে বন্দি থাকা প্রথম সাংবাদিক তিনি। চুং এর সহ-অভিযুক্ত প্যাট্রিক লাম ১১ মাসের সাজা পান।
গ্রেপ্তারের সময় চুং অধুনালুপ্ত স্ট্যান্ড নিউজের প্রধান সম্পাদক ছিলেন, আর লাম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত-সম্পাদক। দুজনই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রায় ১২ মাস জেলে কাটিয়েছেন।