বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় নিন্দার ঝড় নাসিরনগরে আটক ৭৪
2016.11.07
ঢাকা থেকে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৭৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে ওই এলাকার পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত শান্ত হয়নি।
নাসিরনগর ছাড়াও গাইবান্ধা, ফেনী, নেত্রকোনাসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। কোথাও বা হামলার চেষ্টা চলছে। এসবের প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ক্ষোভ–বিক্ষোভ অব্যহত রয়েছে।
এসব ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা ও মানবাধিকার কর্মীরা। দেশের বিভিন্নস্থানে পরপর কয়েক দফা হামলা হওয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।
গত ৩০ অক্টোবর একদল দুর্বৃত্ত নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। ২৮ অক্টোবর নাসিরনগরে জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইস বুক পাতায় একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ওই ঘটনার সূত্রপাত হয়।
ফেইস বুকে রসরাজ ইসলাম অবমাননা করে পোস্ট দিয়েছেন এমন অভিযোগে পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অন্যদিকে একের পর এক নাসিরনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত হামলা হচ্ছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর ওই এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার আলোকে বেনারকে বলেন, নাসিরনগরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা উদ্বেগজনক। এর দায় মূলত পুলিশ ও প্রশাসনের।
তিনি বলেন, রসরাজ নামের যুবকটি আসলে পরিস্থিতির স্বীকার, এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু তার পক্ষে স্থানীয় আইনজীবীরা পর্যন্ত দাড়াচ্ছেন না। মামলাটি ঢাকায় এনে যুবকটিকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।
নাসিরনগরের ঘটনার পর সেখানকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দফায় দফায় গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। সর্বশেষ রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে নাসিরনগরের ওসি আবু জাফর।
৩০ অক্টোবরের হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলায় এ পর্যন্ত মোট ৭৪ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানান ওসি। ওই দুটি মামলায় আসামীর সংখ্যা দুই হাজার চারশ।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি
সংখ্যালঘু ধর্মের নেতারা অভিযোগ করেছেন, দেশের বিভিন্নস্থানে বারবার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটলেও এসবের বিচার হয়নি। নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এ হামলার ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তাঁরা।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বেনারকে বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই বারবার হিন্দুসমাজ তথা সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে।
নাসিরনগরের ঘটনায় বিচার দাবি করে তিনি বলেন, “এ হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করতে হবে। এ ছাড়া অতি শিগগির দেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করাও প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার বেনারকে বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার না হওয়ায় উগ্রগোষ্ঠী সংখ্যালঘু নির্যাতন থেকে বিরত থাকার পরিবর্তে এ কাজে আরও বেশি উৎসাহিত হচ্ছে।”
তিনি বলেন, সম্প্রতি নাসিরনগরে এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা চালানো হয়েছে, তা উদ্বেগজনক।
দায় অস্বীকার মন্ত্রীর
পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতা, হামলার পর তিন দিনেও এলাকায় না যাওয়া এবং পরে হিন্দুদের নিয়ে কটুক্তি করে সাম্প্রদায়িক হামলায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের বিরুদ্ধে। যদিও তিনি তা অস্বীকার করে অভিযোগ প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।
সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন ছায়েদুল হক। ফোকাস বাংলা।
মন্ত্রী বলেন, হিন্দুদের নিয়ে কটুক্তির যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তা প্রমাণ করতে পারলে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন।
গত রোববার নাসিরনগরে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, তাঁর শত্রুপক্ষ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট এই অভিযোগ ছড়াচ্ছে।
মন্ত্রী ছায়েদুল বলেন, “বিএনপি-জামায়াত চক্র শেখ হাসিনার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রাজনীতি নষ্ট করার জন্য এ কাজ করেছে। হাফপ্যান্ট পরা কিছু লোক সেদিনের হামলা-ভাঙচুরে অংশ নিয়েছিল।”
ভারতের উদ্বেগ
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চলা এসব হামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত।
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে এ উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রোববার দুপুরে ‘টেম্পলট্রি’ নামে একটি টুইট অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও মন্দির ভেঙে সহিংসতার কথা উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানানো হলে, জবাবে এ কথা জানান সুষমা স্বরাজ।
এর আগে গত বৃহস্পতিবারও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ নিয়মিত এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন।