নজিরবিহীন ঘোষণায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে
2023.11.28
ঢাকা
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদেরকে নিজ নিজ আসনে প্রয়োজনে “ডামি প্রার্থী” দাঁড় করাতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর এই নির্দেশনার ভিত্তিতে দলটির অনেক নেতাই এখন আনুষ্ঠানিক দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা “বিদ্রোহী প্রার্থী” হিসেবে অংশ নিয়ে অনেক সময় দলীয় প্রার্থীকে টেক্কা দিয়ে বিজয়ীও হয়েছেন। আবার বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে দলীয় ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থী জিতে যেতে পেরেছেন এমন নজিরও রয়েছে অনেক।
তাই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হতে চাইলে সাধারণত তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা সহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে এবারই প্রথম আওয়ামী লীগের মতো প্রথম সারির কোনো দল নিজেদের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়ার বদলে উৎসাহিত করছে — তাও আবার সংসদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচনে।
“২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে বাঁচতে এবার এই পথ বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ,” বেনারকে বলছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নামে একটি নাগরিক সংগঠনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার।
সংবিধান থেকে তত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার প্রতিবাদে ২০১৪ সালে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহ একাধিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে। ফলশ্রুতিতে অর্ধেকেরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্ররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়।
এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বিএনপি সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল। ফলে ২০১৪ সালের মতো এবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের বহু প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখছে শাসক দল।
গত রোববার সকালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক এমন সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীর সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সরাসরি এই বিষয়ে মন্তব্য করেন দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ওই সভায় শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কেউ প্রভাব খাটিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পরিস্থিতি এড়াতে দলীয় প্রার্থীদের প্রয়োজনে “ডামি” বা নামকাওয়াস্তে প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করানোরও পরামর্শ দেন তিনি।
এরপর সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই নজিরবিহীন বিষয়টিকে দলটির “কৌশলগত সিদ্ধান্ত” হিসেবে আখ্যা দেন।
“আওয়ামী লীগ সময়ের প্রয়োজনের আলোকে কৌশল পরিবর্তন করে এগিয়ে যাচ্ছে। দলীয় প্রধানের গাইডলাইন অনুসরণ করে ডামি প্রার্থী দিতে কোনো বাধা নেই,” বলেন তিনি।
অনেক প্রার্থী বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে তৎপর হয়েছেন। যেমন, চট্টগ্রাম-১১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী এম আবদুল লতিফ। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন তারই ছেলে ব্যবসায়ী ওমর হাজ্জাজ। এছাড়া একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
কিন্তু অনেক শক্তিশালী প্রার্থীই দৃশ্যত লোকদেখানো অংশগ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছেন না। তাঁরা বিষয়টিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার প্রচ্ছন্ন অনুমতি হিসেবে দেখছেন। ফলে অনেক নির্বাচনী আসনেই আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীর আবির্ভাব হয়েছে।
রোববার আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা সজল ঢাকা-৫ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে সজল বলেন, “দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শুনে আমি আজ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়লে আমাদের বিদ্রোহী মনে করা হবে না।”
কুষ্টিয়া-১ আসনে দলীয় প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ. ক. ম. সরওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী। কারণ হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বক্তব্যকে তুলে ধরছেন।
“আমাদের নেত্রী বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই,” সাংবাদিকদের বলেন রেজাউল হক চৌধুরী।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম সোমবার যশোর-৩ আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী নাবিল আহমেদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক বিশ্বাস সোমবার রাজবাড়ী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী কেরামত আলীর বিরুদ্ধে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়ারম্যান পদ থেকে সোমবার পদত্যাগ করেছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রউফ কুষ্টিয়া-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এস আয়েশা আক্তার জাহান, অভিনেত্রী মাহিয়া মাহি এবং আওয়ামী লীগের রাজশাহী শাখার ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আকতারুজ্জামান আক্তার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
মঙ্গলবার ব্যবসায়ী নেতা ও দৈনিক সমকাল পত্রিকার প্রকাশক এ কে আজাদ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ফরিদপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। সেখানে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক। এ কে আজাদ প্রথমে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
এভাবে বাড়ছেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা। তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উপস্থিতি থাকলে নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ বাড়বে — এমনটা হয়তো আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা; তবে এর ফলে ভোটাররা নিজেদের পছন্দসই প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন।
বেনারকে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে থাকলে সহিংসতার ঝুঁকিও তৈরি হয়। দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উভয়েই আওয়ামী লীগের হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দোটানায় থাকে।
“গত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও এর বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সহিংসতায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে,” বলেন বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি আরও বলেছেন, “আওয়ামী লীগের এই কৌশলের ফলে যেসব দল কিছু আসন পাওয়ার লোভে কিংস পার্টি তৈরি করে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে, তাদের কপাল পোড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “সহিংসতার কোনো সুযোগ নেই, কারণ ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ডামি প্রার্থীরা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে নির্বাচনে লড়বেন।”
এসব প্রার্থীরা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তুলবেন না — এমনটিই তাঁর ইঙ্গিত।