ক্ষমতাসীন দলের নিখোঁজ এমপি ভারতে খুন
2024.05.22
ঢাকা
ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে নিখোঁজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার কলকাতায় ‘পরিকল্পিত’ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ।
বুধবার সকালে এমপি আনারের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এমন সংবাদ প্রচার হতে থাকলেও দুপুর নাগাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়।
যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ এবং নিহতের পরিবার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক বার্তা দিয়েছেন, তবুও বিভিন্ন সূত্রের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে লাশ উদ্ধার নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, আনারের লাশ উদ্ধার হয়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, লাশ উদ্ধারে বাংলাদেশ ও ভারতীয় পুলিশ একসঙ্গে কাজ করছে।
‘বাংলাদেশিরাই খুন করেছে’
বুধবার ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তা হলো, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষ জড়িত।”
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তারা অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে বলে জানান মন্ত্রী।
“আমরা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টা করছি। এটা খুন। তাঁকে (আনোয়ারুল আজিম) হত্যা করা হয়েছে এটা আমরা নিশ্চিত,” বলেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ভারতীয় পুলিশ হত্যার পেছনের উদ্দেশ্য জানতে এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে।
লাশ উদ্ধারের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান তদন্তের স্বার্থে কোনো তথ্য জানাতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “খুনের মোটিভ, কোথায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, সব তথ্য আমরা আপনাদের (সাংবাদিকদের) জানাব।”
“আনোয়ারকে ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ভারতীয় পুলিশ,” বলেন তিনি।
চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার পর এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমাদের পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। খুব শিগগির আমরা হত্যার উদ্দেশ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হব।”
আনোয়ারুল আজিম গত ১১ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান এবং তিনি গত ১৪ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন।
ওই ফ্ল্যাটে লাশ পাওয়া যায়নি
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে যেখানে আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে সেখানে পুলিশ তাঁর লাশ পায়নি।
কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ এই তথ্য শেয়ার করেছে বলে জানান তিনি।
“এমপি আনোয়ারুলের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। যে ফ্ল্যাটে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে সেই ফ্ল্যাটে লাশ পায়নি কলকাতা পুলিশ। তবে হত্যার পর কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আনোয়ারুল আজিমকে বাংলাদেশের কিছু অপরাধী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের তিনবারের এই সংসদ সদস্য হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।”
এই হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “এটি পারিবারিক, আর্থিক বা এলাকার কোনও দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনের সাথে সম্পর্কিত কিনা তা আমরা তদন্ত করছি।”
“আমরা বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি। সব সময় তাদের সাথে কথা বলছি। অনেক তথ্য পাচ্ছি... তদন্তের স্বার্থে আমরা সেসব কথা বলতে চাই না,” বলেন হারুন।
তিনি বলেন, এই সংসদ সদস্য যেহেতু সংসদ এলাকা থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন সেহেতু শেরেবাংলা নগর থানায় এই ঘটনায় একটি মামলা হবে। এমপি আনারের মেয়ে এই মামলা করবেন।
“কিছু অপরাধীকে আমরা আইনের আওতায় এনেছি। তদন্তের স্বার্থে আটককৃতদের নাম আমরা গোপন রাখছি। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে,” বলেন তিনি।
তবে এমপি আনোয়ারুল আজিমের লাশ উদ্ধারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাব দেননি হারুন।
এদিকে বুধবার গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে হারুনের সঙ্গে দেখা করে আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তাঁর বাবার হত্যাকারীদের বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
এক বিবৃতিতে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনারের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কলকাতায় হত্যা মামলা
এমপি আনারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কলকাতার আপডেট জানতে চেয়ে বেনারের পক্ষ থেকে সেখানার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, “বাংলাদেশে মন্ত্রীরা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাই অফিসিয়াল বক্তব্য এবং বর্তমান ঢাকা ও কলকাতা পুলিশ নিজেদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ করছে।”
এমপি আনার নিখোঁজ হাবার পর থেকেই ঘটনাটি নিবিড়ভাবে কভার করছেন কলকাতার সাংবাদিক শুভজিৎ পুততুন্ড।
তিনি টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় যে মিসিং ডায়েরি হয়েছিল সেটি আজ নিউ টাউন থানায় হত্যা মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।”
শুভজিৎ বলেন, “এই ঘটনায় শুরু থেকেই স্থানীয় পুলিশের মধ্যে বিশেষ করে ব্যারাকপুর থানা ও নিউ টাউন থানার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা গেছে। ব্যারাকপুরে লোকসভা ভোট থাকায় এই ঘটনাটি কিছুটা কম গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয়েছে।”
তিনি বলেন, পুরো ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তাতে প্রবলভাবে ধারণা হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ভারতে মাটিতে বাংলাদেশ এমনকি অন্য কোনো দেশের সংসদ সদস্যের এভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বলে উল্লেখ করেন শুভজিৎ।
আলোচিত ছিলেন এমপি আনার
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজিম আনার ২০০৮ সালে ইন্টারপোলের কাছে ওয়ান্টেড ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেই তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়ে। ২০০৯ সালের পর তাঁর বিরুদ্ধে ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা থানায় থাকা সকল মামলা প্রত্যাহার করা হয়।
২০০৯ সাল পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ২০টি মামলা ছিল বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা কমতে থাকে এবং ২০১৪ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বেশিরভাগ মামলায় খালাস পেয়ে যান।
এমপি হওয়ার আগে আনার কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০০৪ সালে তিনি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন এবং গত বছর তাঁকে উপজেলা শাখার সভাপতি করা হয়।