রিজার্ভ চুরি: টাকা উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মামলা

উত্তর কোরিয় হ্যাকারদের সাথে ফিলিপাইনের ব্যাংকারদের ষড়যন্ত্রে তিন বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধার করতে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে (যুক্তরাষ্ট্র সময় বৃহস্পতিবার বিকে​লে) নিউ ইয়র্কের সাউদার্ন ম্যানহাটান জেলা আদালতে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাথে কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলাটি দায়ের করা হয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।

বেনারনিউজ মামলার ১০৩ পৃষ্ঠার এজাহারের একটি কপি হাতে পেয়েছে। এতে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশের অর্থ চুরির ঘটনাকে ‘আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্যতম বড় চুরি’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, এই চুরির জন্য ‘কয়েক বছর ধরে ব্যাপক ষড়যন্ত্র’ হয়।

চুরির ঘটনায় ক্যাসিনো মালিক, কিছু চায়না নাগরিক এবং হ্যাকারদের সাথে আরসিবিসির আট কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে এক বিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা চালিয়ে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে চোররা।

মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো ফেডারেল রিজার্ভ যা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত।

অভিযোগে বলা হয়, ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকার, যারা ২০১৪ সালে সনি পিকচার ইন্টারটেইনমেন্টের কম্পিউটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে। তারা একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে চুরির ঘটনা ঘটায়।

হ্যাকাররা ক্ষতিকর ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে সার্ভারে প্রবেশ করে। ফাইলের নাম পরিবর্তন করে পরিচয় ও লগইন তথ্য চুরি করে সুইফট ব্যবস্থায় প্রবেশ করে ফেডারেল রিজার্ভের বাংলাদেশ ব্যাংকের অক্যাউন্ট থেকে ভুয়া আদেশের মাধ্যমে আমেরিকার বাইরে অর্থ নিয়ে যায়।

অর্থ চুরির জন্য উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা তাদের ফিলিপাইনের সহযোগীদের সাথে হাত মেলায়।

ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম হলো ফিলিপাইনের ব্যাংক আরসিবিসি। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে চুরি করা অর্থ ফিলিপাইনের আরসিবিসিতে বছর খানেক আগে খোলা চারটি ডলার অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ করা হয়।

ফিলিপাইনে পৌঁছানোর পর আরসিবিসি ওই অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তি, সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠান, ক্যাসিনো ও অন্যান্যদের দিয়ে দেয়।

এজাহারে বলা হয়, বিবাদীদের সবাই এই চুরির সুবিধাভোগী।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা রাজী হাসান বলেন, “যেহেতু নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি গেছে সেহেতু নিউ ইয়র্কেই মামলা দায়ের করতে হয়েছে।”

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও নিউ ইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংক শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সহায়তা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে বলে জানায়। এতে বলা হয় ফেডারেল রিজার্ভ, বাংলাদেশের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আইনগত লড়াইয়ে কারিগরি সহায়তা দেবে।

রাজী হাসান বলেন, “এই অর্থ চুরির ঘটনার সাথে কারা জড়িত তাদের বের করতে ফৌজদারী তদন্ত করছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ—সিআইডি। তদন্ত শেষ হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করবে পুলিশ।”

এছাড়া যুক্তরাষ্টের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স—এফবিআই ঘটনাটির ফৌজদারি তদন্ত করেছে বলেও জানান তিনি।

মামলার এজাহার ঘেঁটে দেখা যায়, এই মামলায় বাংলাদেশি বা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে অভিযুক্ত করা হয়নি।

The logo of the RCBC bank is seen at the RCBC building in Manila's financial district on March 11, 2016. - A Philippine bank said it is investigating an 81 million USD deposit after Bangladesh accused Chinese hackers of stealing from a US account and illegally moving the funds online to the Philippines and Sri Lanka. (Photo by NOEL CELIS / AFP) (NOEL CELIS)

যেভাবে চুরি হয়

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাইবার সিস্টেম হ্যাক করে চোরেরা নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে টাকা ছাড়ের জন্য ৩৫টি পে অর্ডার পাঠায়। অর্থ পাচারের প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ফিলিপাইনের একটি দৈনিকে এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি সবার নজরে আসে।

মোট অর্থের মধ্যে ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলংকার একটি এনজিওর নামে পাঠানো হয়। কিন্তু শ্রীলংকার ওই এনজিও’র নামের বানানে ফাউন্ডেশন এর পরিবর্তে ফান্ডেশন লিখলে ওই টাকা আটকে দেয় শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

শ্রীলংকায় পাঠানো টাকা ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ।

আর বাকি ৮১ মিলিয়ন ডলার যায় ফিলিপাইনের আরসিবিসি’তে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘স্টপ পেমেন্ট’ আদেশ পাঠানো হলেও তা অগ্রাহ্য করে টাকা দিয়ে দেয় আরসিবিসি। ম্যানিলার স্থানীয় মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেম মানি রেমিট্যান্স কোম্পানির মাধ্যমে সেই টাকা চলে যায় তিনটি জুয়া খেলা প্রতিষ্ঠানে।

একটি জুয়া খেলার প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে তা ফিরিয়ে দেয় ফিলিপাইন সরকার। তবে বাকি টাকার কোনো হদিস এখনো পাওয়া যায়নি।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ওই অর্থ চুরির জন্য ‘জটিল ষড়যন্ত্রের’ আশ্রয় নেয় হ্যাকাররা।

এফবিআই তাঁদের তদন্তে বলেছে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির সাথে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা জড়িত।

তদন্তের সাথে জড়িত সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “তদন্তের জন্য ফিলিপাইন ও অন্যান্য দেশ থেকে যতটা সহযোগিতা আমরা আশা করেছিলাম ততটা সহযোগিতা পাচ্ছি না।”

তিনি বলেন, “বিদেশ থেকে তথ্য আনা অনেক সময়সাপেক্ষ ও কিছুটা জটিল ব্যাপার। আমরা অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছি। আমরা এফবিআইয়ের কাছ থেকেও তথ্য ও কাগজপত্র পেয়েছি।”

তিনি বলেন, হ্যাকিংয়ের সাথে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা জড়িত কি না সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।

তবে তাঁর মতে, ওই হ্যাংকিং যে স্পাইওয়ার ব্যবহার করা হয় সেগুলো চীন, কোরিয়া, হংকং ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবহৃত হয়।

তিনি বলেন, চুরি যাওয়া অর্থ চীন ও হংকংয়ে গেছে সেব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত।

মামলায় আরসিবিসিসহ সাত প্রতিষ্ঠান ও ১৬ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া এতে আরো ২৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি জড়িত ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়।

এজাহারে চুরি যাওয়া আট কোটি দশ লাখ ডলারের সাথে, মামলার খরচ ও আনুষাঙ্গিক ক্ষতিপুরণ পাওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ।

নিজেদের দায় এড়ানোর কৌশল : আরসিবিসি

এদিকে এই মামলাটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদের দায় এড়ানোর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয় বলে শুক্রবার এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছেন আরসিবিসির প্রধান আইনজীবী টেই-হেঙ চেঙ।

“ওই টাকা চুরির ঘটনায় আরসিবিসির কিছুই করার ছিল না, এবং এবিষয়ে সব ধরনের তদন্তে সম্পূর্ণ সহায়তা করা হয়েছে,” মামলার প্রতিক্রিয়ায় বলেন টেই-হেঙ চেঙ।

তিনি বলেন, “এই মামলা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদের দায় এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।”

মামলাটি সম্পূর্ণ ‘ভিত্তিহীন এবং ‘লোক দেখানো’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাঁরাও আইনগতভাবে মামলাটি মোকাবেলা করবেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস হলে মামলা করার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার মাত্র কিছুদিন আগে না করে তা তিন বছর আগেই করতে পারত।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতার সুযোগেই হ্যাকাররা টাকা চুরি করেছে, তাই এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থ চুরি সংক্রান্ত সরকারি দেওয়ানী তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বেনারকে বলেন, “এই অর্থ চুরির সাথে আরসিবিসি পরিষ্কারভাবে জড়িত। আর সেকারণে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরসিবিসি’কে জরিমানা করেছে। আরসিবিসি ব্যাংকের তখনকার ম্যানেজারকে জেল দিয়েছে।”

ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, “আরসিবিসি কোনোভাবেই এই অর্থ চুরির ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।”

প্রসঙ্গত গত ১০ জানুয়ারি এই অর্থ পাচার সংক্রান্ত মামলায় আরসিবিসির সাবেক শাখা প্রধান মায়া সান্তোস দেগুইতোর সাজা দিয়েছে দেশটির আদালত।