আতঙ্কে মানুষ, অপরাধ দমনে অসহায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
2025.02.26
ঢাকা

সন্ত্রাস দমনে সেনা নেতৃত্বাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর যৌথ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলার মধ্যেই বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আকস্মিক অবনতি সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধানসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারবার সতর্ক করলেও জনমনে স্বস্তি ফেরেনি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাজমুল হক বেনারনিউজকে বলেন, ব্যাপক বদলি-ওএসডিতে স্বাভাবিক মনোবল নিয়ে কাজ করতে পারছে না পুলিশ। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার মানসিকতা অনেকেরই নেই, নিজেকে রক্ষা করে চাকরি করছে কেউ কেউ।
“পুলিশ যেভাবে হেলেদুলে কাজ করছে, তাতে মনে হচ্ছে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উত্তরণে দীর্ঘ সময় লাগবে। পুলিশ তাঁর মনোবল হারিয়েছে, কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে না,” বলেন তিনি।
তবে পুলিশ বলছে, তাদের চেষ্টার কমতি নেই। অপারেশন ডেভিল হান্টে বুধবার পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ১০ হাজার ৫০০ জন আসামিকে, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
বেনারনিউজের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত দুই মাসে অন্তত ২৫টি জায়গায় প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে জনগণের ভূমিকা লাগবে। মাঠে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়ছে।”
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা ছাড়া অন্য দলের বা অন্য কোনো বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে গেলে কিছু জায়গায় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে বলে স্বীকার করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এদিকে, মঙ্গলবার শহীদ সেনা দিবসের এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, “আজকে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে না, এটার বড়ো কারণ হচ্ছে, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকেই জেলে। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন্ড করে যদি আপনারা মনে করেন যে, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে, তা হবে না। কোনো বাহিনীকে বাদ দিয়ে, কারো ওপর কলঙ্ক চাপিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।”
যেসব ঘটনা উদ্বেগ ছড়িয়েছে
গত দুই সপ্তাহে ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ ও প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করার মতো কয়েক ডজন ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়, নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বেগ জানান। সন্ধ্যার পর চলাচলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আতঙ্কের কথা জানান।
গত সপ্তাহে রাজধানীর উত্তরায় এক দম্পতিকে কুপিয়ে জখম করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে একটি বাসে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানায়, ওই বাসে ডাকাতি হলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি।
এর মধ্যে গত রোববার রাতে রাজধানীর একাধিক জায়গায় গুলি করে ছিনতাই ও ডাকাতির খবর পাওয়া যায়। রাজধানীর বনশ্রী ডি ব্লকে রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে আনোয়ার হোসেন নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ১৬০ ভরি স্বর্ণ ও এক লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। মোবাইলে ধারণ করা এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বনশ্রীর ওই ঘটনার আগে শনিবার রাতে নওগাঁর পত্নীতলায় সড়কে গাছ ফেলে একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাসে ডাকাতি হয়। তার আগের দিন শুক্রবার ঝিনাইদহে তিনজনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি
অপারেশন ডেভিল হান্টের মধ্যেই এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবি ওঠে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সোমবার রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমাদের ব্যর্থতা আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।”
নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সারাদেশে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও দেশের কয়েকটি বড়ো কলেজে নারী শিক্ষার্থীরা মিছিল ও মানববন্ধন করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার মধ্যরাতে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে.জে (অব.) জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেছেন, ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে।
“আমার পদত্যাগের দাবি যারা করছেন, তাদের চাওয়া হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। সেটা হয়ে গেলে তো আর পদত্যাগের প্রশ্ন আসে না,” বলেন তিনি।
তবে শেষ রাতের দিকে ছিনতাইকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনের কিছুক্ষণ পরই তাঁর বাসভবন থেকে আট কিলোমিটার দূরের দক্ষিণখানের তালতলায় এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন এক পোশাক শ্রমিক।
নারী নিপীড়ন বেড়েছে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিমেতাল ভূমিকায় সন্ধ্যার পরই ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তাহীনতাও বেড়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র বুধবার বলেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, খুন, শারীরিক নির্যাতন ও নিপীড়ন, অপহরণ অনেকটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও তাঁদের এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হতে দেখা যাচ্ছে, যা কাম্য নয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, গত দুই সপ্তাহে ধর্ষণের অভিযোগে অন্তত ২৪টি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা আদিবা নুসরাত বেনারকে বলেন, “আগে কখনো আমাকে ধানমন্ডি এলাকায় হয়রানি হতে হয়নি। কয়েকদিন আগে রিকশায় বাসায় ফেরার পথে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলের ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছি যা নিজের এলাকায় কখনো কল্পনাও করিনি।”
পরিসংখ্যান বলছে অপরাধ বেড়েছে
পুলিশের দেয়া অপরাধের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি, এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ছয় বছরের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এসব অপরাধ সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী আবু আহমদ ফায়জুল কবির বেনারকে বলেন, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় এক ধরনের ভয় কাজ করছে মানুষের মধ্যে।
“অপরাধের পরিসংখ্যান আমাদের অপরাধের চিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা দিচ্ছে। কিন্তু এবার যেটা ব্যতিক্রম সেটা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ভয়। সাম্প্রতিক ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে যে আইনশৃঙ্খলার বাহিনীগুলোর কৌশল কাজ করছে না।”
পুলিশের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক বেনারকে বলেন, “মাসে মাসে অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। এক বছরের জানুয়ারিতে অপরাধ বাড়লে পরের বছরের জানুয়ারিতে অপরাধ কমে। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দিতে সবসময় সক্রিয় ও সচেষ্ট আছে। ”
বাড়ছে মব প্রবণতা
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে বাড়ছে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উত্তরা বিএনএস সেন্টার এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই যুবককে পিটিয়ে গুরুতম জখম করে উত্তেজিত জনতা। পরে দুইজনেকই ফুটওভার ব্রিজের ছাদের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
একই রাতে গাজীপুরের টঙ্গি এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে মারে উত্তেজিত জনতা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে গণপিটুনিতে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার রাতে টহল কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “আমি কোনভাবেই সাধারণ মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বলছি না। ল ইনফোর্সিং এজেন্সির কাছে তাদের তুলে দেন।”
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বেনারকে বলেছেন, ‘অপরাধীদের দৌরাত্ম্য যতটা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা তার চেয়ে পিছিয়ে আছে, যে কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এর সাথে যোগ হয়েছে ‘মব’ নামের উপদ্রব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এসব বিষয় খুবই উদ্বেগজনক,” বলেন তিনি।