রিজার্ভ চুরি: যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে অভিযুক্ত করলেও বাংলাদেশের ধীরে চলা নীতি

জেসমিন পাপড়ি
2017.03.24
ঢাকা
রাজধানী ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন। রাজধানী ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন। মার্চ ২৪, ২০১৭।
স্টার মেইল

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির পেছনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা-এনএসএ সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের দায়ী করলেও সিআইডির তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপে যাবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যেটা বলছে, হয়ত তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ রয়েছে। আমাদের অ্যাকাউন্ট যুক্তরাষ্ট্রে, তাই তাদেরও দায়িত্ব আছে। প্রমাণ পেলে তারা ব্যবস্থা নেবে।”

“বিষয়টি সিআইডির তদন্তাধীন আছে। এই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ চুরির ব্যাপারে কিছু করতে চাই না আমরা,” জানান রাজী হাসান।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনএসএ’র কাছ থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া এই চুরির বিষয়ে বাংলাদেশের তদন্ত প্রতিবেদনও শিগগির প্রকাশ করা জরুরি বলেও মনে করছেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে আমেরিকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছে কী প্রমাণ বা তথ্য আছে খুঁজে বের করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা উচিত বাংলাদেশের।”

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্কে সংরক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে হ্যাকাররা। ওই ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।

অনেক চেষ্টার পর শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত আসে। তবে ফিলিপাইনে চলে যাওয়া বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ফেরত পাওয়া যায় মাত্র দেড় কোটি ডলার। এখনও বাকি রয়েছে সাড়ে ৬ কোটি ডলার বা ৫১০ কোটি টাকা।

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্ত চীনা দালালরাও

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা জড়িত বলে গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনের আসপেন ইনস্টিটিউটে এক গোলটেবিল বৈঠকে অভিমত দেন এনএসএ’র উপপরিচালক রিক লেজেট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা ফরেন পলিসির এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

এদিকে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র মামলা করতে পারে বলেও খবর প্রকাশ করেছে মার্কিন দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল।

রিজার্ভ চুরির ঘটনা সম্পর্কে জানেন এমন কর্মকর্তাদের সূত্র থেকে ডয়চে ভেলে, রয়টার্স ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, এই অর্থ চুরিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সঙ্গে চীনা দালালেরাও জড়িত। তাই এ সংক্রান্ত এফবিআইয়ের মামলায় পুরো উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও জড়িয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, মামলার পাশাপাশি ফেডারেল রিজার্ভ পর্যায়ে দালালি ব্যবস্থায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও ভাবছে মার্কিন কোষাগার।

ফিলিপাইনের আগ্রহে ভাটা

শুরু থেকে চুরি যাওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিষয়টি এখন আর গুরুত্ব দিচ্ছে না ফিলিপাইন সরকার।

এই চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরেই রয়েছে এমন ভাবনা থেকেই বিষয়টির প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন দেশটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ২৩ মার্চে প্রকাশিত বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন তথ্যই দিয়েছেন ফিলিপাইনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস। দেশটির ইনকোয়ারার পত্রিকার এই সাংবাদিকই প্রথমে রিজার্ভ চুরির ঘটনা ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন।

সাক্ষাৎকারে ড্যাক্সিম লুকাস বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদল এবং ব্যাংক তহবিল লোপাটের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কেউ জড়িত এমন ধারণার কারণেই আগ্রহ হারিয়েছে ফিলিপাইন।

বিষয়টি অস্বীকার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা রাজী হাসান বেনারকে বলেন, “অর্থ ফেরতের বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। ওই সাংবাদিক যা বলেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত মত। ফিলিপাইনের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছি। সেখানে সবকিছুর অগ্রগতি হচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।”

উল্লেখ্য, রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় দেশটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তাসহ কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ফিলিপাইন। রিজাল ব্যাংকের এসব কর্মকর্তার মাধ্যমেই ব্যাংক থেকে টাকা জুয়ার মার্কেটে প্রবেশ করে বলে অভিযোগ ওঠে।

চুরির টাকা উদ্ধার করতে গত বছরের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ফিলিপাইনের সহায়তা পাওয়ার আশায় দেশটি সফর করে। তবে ওই সফরে পর সেখানে আর কোনো অগ্রগতি নেই বলে সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস।

তবে রাজী হাসান বলেন, “এটাও সত্য নয়। আইনমন্ত্রী যাওয়ার পরে আইনজীবীসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও একটি প্রতিনিধি দল ফিলিপাইন সফর করেছে। আমরা অগ্রগতি টের পাচ্ছি।”

ড্যাক্সিম লুকাস বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ফিলিপাইনের সংসদের উচ্চকক্ষ সিনেটে কয়েকবার শুনানি হলেও দেশটির আইনপ্রণেতারা গত কয়েক মাসে বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

গত বছর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ফিলিপাইনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়ে ড্যাক্সিম লুকাস জানান, এখন ফিলিপাইনের আইনপ্রণেতারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বাংলাদেশের টাকা নিয়ে শুনানির বিষয়টি চাপা পড়ে আছে। বাংলাদেশের অর্থ ফিলিপাইনের কোথাও আছে বিশ্বাস করলেও তা খুঁজে বের করার আগ্রহ পাচ্ছেন না তাঁরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি অতি শিগগির পরিষ্কার হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ বিষয়ে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “ঘটনা যেটা ঘটেছে, এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগাযোগ ছিল বলে দেশে বিদেশে অনেকেরই ধারণা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় সে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। এ কারণে প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া জরুরি।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রাপ্তি রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।