বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি
2024.04.25
ঢাকা
ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মের সংবাদ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের যিনি পাস দেবেন, শুধুমাত্র তাঁর সঙ্গেই দেখা করা যাবে, অন্য কারও সঙ্গে নয়। এটাই আপাতত সিদ্ধান্ত।”
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা স্পর্শকাতর ব্যাপার থাকে। সব কিছু বিবেচনা করেই এই ব্যবস্থা।
এই কড়াকড়ির প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ঢাকার মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ করেছেন ব্যাংকিং খাত নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকরা।
এদিন বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা অর্থনীতি বিটের রিপোর্টাররা সেখানে অবস্থান করেন।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছেন, সাংবাদিকরা যাতে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো বাধার মুখে না পড়েন।
সাংবাদিকদের অবস্থানে অংশ নিয়েছিলেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সিনিয়র রিপোর্টার মুস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা অতীতে কখনো বাংলাদেশে ব্যাংকে প্রবেশের ক্ষেত্রে এতটা বাধার মুখে পড়িনি। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের বেহাল অবস্থা, দুর্নীতি ও ব্যাংকগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি মূল্যায়ন প্রকাশ্যে আসার পর চরম কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।”
তিনি বলেন, “এখন কোনো কর্মকর্তার কাছে পাস নিয়ে যেতে হবে—এমন বিধান করা হলে, ওই কর্মকর্তা কোনো তথ্যই দেবেন না। কারণ এতে তাঁর বিপদ বাড়বে।”
এই ব্যবস্থা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য পুরোপুরি প্রতিবন্ধক বলে মন্তব্য করেন মুস্তাফিজুর রহমান।
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংককে বুঝতে হবে, তাদের এই অবস্থান দুর্নীতির পক্ষে যায়।”
ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বেনারকে বলেন, “আমরা গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তবে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি। আগামী ৮ মে এই বিটের রিপোর্টারদের নিয়ে একটি কর্মশালা হবে, সেখানে গভর্নর থাকবেন। আশা করি, তারপর থেকে সব প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।”
এদিকে এক বিবৃতিতে ইআরএফ বলেছে, “গত ৫৩ বছর ধরে রিপোর্টাররা অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। কখনো তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। হঠাৎ করে রিপোর্টারদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করায় ব্যাংকিং খাত নিয়ে ভুল রিপোর্টিং হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে, যা কোনো পক্ষেরই কাম্য নয়।”
ইআরএফ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন টপ সিক্রেট ডকুমেন্টস নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান তিনি—উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
এতে আরও বলা হয়, “গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, সাংবাদিকরা যে কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চান, ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে পাস নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এছাড়া, সাংবাদিকরা পাস নিয়ে মুখপাত্রের কাছে যেতে পারবেন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কাশেম বেনারকে বলেন, “এই প্রস্তাব মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের ইতিহাসে কখনো এভাবে সাংবাদিকতা হয়নি। এই প্রক্রিয়ার ফলে সোর্স ও প্রতিবেদক দুইজনেরই এক্সপোজ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি প্রবল।”
দুর্নীতিবাজদের পক্ষে এই অবস্থান: টিআইবি
সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করে যে পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করেছে, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিকদের প্রবেশে যে কড়াকড়ি আরোপ করেছে, তা পুরোপুরি অযৌক্তিক।
“সাংবাদিকরা যে কাজ করে তা জনস্বার্থে এবং পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে করে। এখানে তাদের বাধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে অবস্থান নিয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “এই ভূমিকার কারণে প্রশ্ন উঠবে, বাংলাদেশ ব্যাংক কার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে? এই অবস্থানের মাধ্যমে হয় তারা নিজেদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতাকে ঢাকার চেষ্টা করছে, নয়তো দুর্নীতিবাজদের বাঁচানোর জন্য কাজ করছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ভূমিকা পুরোপুরি দুর্নীতিবাজদের পক্ষে যায়।”
কী ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে
গত মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের “ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স এবং হিট ম্যাপ” প্রতিবেদনের একটি অংশ প্রকাশ পায়। যেখানে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি ব্যাংকসহ নয়টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫৪টি ব্যাংকের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যেখানে ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ফুটে উঠেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী রেড জোনে রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২৯টির মতো ব্যাংক ইয়েলো জোনে রয়েছে। যার অর্থ হলো, এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো এবং খারাপের মধ্যে রয়েছে।
মূলধনের পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণমান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন, তারল্য ও বাজারের ঝুঁকির ওপর সংবেদনশীলতার আলোকে এই মূল্যায়ন করা হয়।
প্রসঙ্গত, রেটিং পয়েন্ট এক হলে সেরা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এই পয়েন্ট পাঁচ হয়ে গেলে সবচেয়ে খারাপ হিসেবে বিবেচিত হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।