মিয়ানমার পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় বাংলাদেশ সীমান্তে নানা প্রস্তুতি
2024.04.29
ঢাকা
মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে আগামী মে মাসে সহিংসতা আরো বাড়তে পারে-এমন আশঙ্কা থেকে কঠোর হওয়ার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।
গত রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলো সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড (বিসিজি) যে পরিস্থিতি তুলে ধরেছে তাতে মিয়ানমারের চলমান সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সংসদীয় কমিটিতে আলোচিত এই প্রতিবেদনের একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে।
বিষয়গুলো নিয়ে কমিটিতে আলোচনার বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন কমিটির সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদু।
তিনি বেনারকে বলেন, “সেখানে (মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে) যেহেতু একটি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, সেহেতু আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নানা রকম প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সীমান্ত এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি এবং সেখানকার পরিস্থিতির আলোকে করণীয় কি হবে, তার ওপর বাহিনীগুলো কমিটিতে তথ্য উপস্থাপন করছে।”
নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে আশঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, “রাখাইনে পরিস্থিতির কারণে যদি নতুন করে আরো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে তবে সেই বোঝা বহনের সক্ষমতা আমাদের নেই। তাই আমাদের বাহিনীগুলো তৎপর যাতে কোন প্রকার অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে।”
কিন্তু মিয়ানমারের চলমান সংঘাতের ফলে বার বার যে সেখানকার মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি) ও সেনা বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে তাদের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কি এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেখুন এই বিষয়টা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেয়ে ভিন্ন। আমরা এসব লোকদের ফেরত পাঠাতে পারছি। এখন কিন্তু একজনও আমাদের দেশে নেই। সবাই ফেরত গেছে।”
যে কারণে অনুপ্রবেশ বাড়তে পারে
সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর মাঝে চলমান যুদ্ধাবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারি বাহিনী ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সদস্যরা প্রায়শই পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বিধায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড টহল জোরদার করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “যুদ্ধাবস্থার প্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তাহীনতার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে প্রবেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১২৩ জন মিয়ানমার নাগরিককে (বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত) পুশব্যাক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “মে ২০২৪ নাগাদ টেকনাফ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধ পরিস্থিতির আরো অবনতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বিজিপি সদস্যদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেতে পারে।”
যেসব করণীয় নির্ধারণ হয়েছে
বৈঠকে বিজিবির উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব ঝুঁকি সামনে রেখে তারা কাজ করছে তার মধ্যে রয়েছে, মিয়ানমারের নাগরিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ; বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অরক্ষিত স্থল ও জল সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের প্রদত্ত রেশনের অবৈধ পাচার রোধ করা।
এছাড়াও মিয়ানমার সেনা ও আরাকান আর্মিদের আপদকালীন সময়ে মাদকের বিনিময়ে রেশন সরবরাহের ফলে মাদক ও চোরাচালানকৃত পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার কারণে আগ্নেয়াস্ত্র উক্ত এলাকায় সহজলভ্য হওয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করতে পারে।
“স্থানীয় আদিবাসী ও মগ সম্প্রদায়ের সাথে আরাকান আর্মির সখ্য থাকায় আরাকান আর্মি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে,” বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত পিলার ৩৫-৪১ নং এলাকায় অধিকসংখ্যক বিজিবি মোতায়েনের পাশাপাশি টহল জোরদার করা প্রয়োজন; নাফ নদী ঘেঁষা চৌধুরী পাড়া, লেদা বাজার, লোম্বাবিল, জাদিমুরা ও বোরোতোলি পয়েন্টগুলোর মধ্যকার রুটসমূহে নিরাপত্তা টহল বৃদ্ধি করা যাতে কোনোভাবেই রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহে বিদ্যমান সন্ত্রাসী গ্রুপসমূহ কোনোভাবেই যেন উসকানি প্রদান বা ক্যাম্প এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য নিয়মিত টহল এবং সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে স্থানীয় জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে স্থানীয় দালাল ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিদের পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন এবং সীমান্ত এলাকায় সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে নির্যাতনের অভিযোগ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফর্টিফাই রাইটস গত ২৬ এপ্রিল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট সহিংসতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে সেখানে বিজিবির হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেক রোহিঙ্গা।
“বাংলাদেশ সরকারের উচিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ ও চলমান গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মারধর ও জোরপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সাথে জড়িত বাংলাদেশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে ছয়টি ঘটনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা তিন শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পিটিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।
“মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ তার সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত দিচ্ছে এবং এর কর্মকর্তারা মিয়ানমারে নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের মারধর করছে,” বলেন ফর্টিফাই রাইটসের নির্বাহী পরিচালক অ্যামি স্মিথ।
এতে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিল মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পালানোর চেষ্টা করেছে এমন রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে মংডু টাউনশিপ এলাকার নয়জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে এই সংগঠন, যারা রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধ এবং গণহত্যা থেকে পালিয়েছে এবং বিজিবি তাদের ফেরত পাঠিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে জাতিগত সংঘাতের মুখে পালিয়ে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের উচিত চলমান সংঘাতে আক্রান্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রক্ষা করা এবং শরণার্থীদের অধিকার লঙ্ঘনের জন্য সীমান্তরক্ষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় মানবাধিকার সংগঠনটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের টেকনাফে একজন বাংলাদেশ নৌ কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছে এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া নয়জন রোহিঙ্গার মধ্যে ছয়জন বিজিবির হাতে নিজেদের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।
বিজিবি সদস্যদের হাতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, “কোনো ধরনের নির্যাতন বা মারধরের ঘটনা ঘটেনি। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
সার্বিক পরিস্থিতি চাপ তৈরি করছে শরণার্থীদের ওপর
রাখাইনের পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের প্রস্তুতি সার্বিকভাবে বর্তমানে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য চাপ তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা ও সাধারণ শরণার্থীরা।
রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং বেনারকে বলেন, “রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হবার অবশ্যই কারণ আছে। আর সেই উদ্বেগ থেকে বাংলাদেশ যেসব প্রস্তুতি নিচ্ছে তারই অংশ হিসেবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।”
“এই নজরদারি বাড়ানো স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এর ফলে শরণার্থীদের ওপর নানা ভাবে চাপ বাড়ছে কারণ অনেক শরণার্থী অপ্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ ও নানা রকম অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন,” বলেন এই রোহিঙ্গা নেতা।
রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার জন্য কোন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের শরণার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন কিনা তা তার জানা নেই দাবি করে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না চরম বিপদগ্রস্ত না হলে কোনও রোহিঙ্গা নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে এখানে আশ্রয়ের জন্য আসতে চায়। যদি কেউ চায়ও আমি বলবো এই ভুল না করতে, কারণ এখানকার জীবন কোনও উন্নত জীবন নয়।”
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মো. ইউনুস বেনারকে বলেন, “রাখাইনের খারাপ পরিস্থিতি মানেই আমাদের জন্য নতুন নতুন চিন্তার কারণ। আমাদের জীবন এমনিতেই বন্দি জীবন তার ওপর একের পর এক নানা রকম বিধিনিষেধ।”
এসব চাপ প্রতিনিয়তই সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাবায় জানিয়ে তিনি বলেন, “একটি শান্তির জীবনের অপেক্ষা মনে হয় আমাদের কখনোই শেষ হবে না।”