এস আলম গ্রুপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক
2024.08.21
ঢাকা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথ্বানের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, যেটি দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে তৃণমূল পর্যন্ত সেবা বিস্তৃত করেছে।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হিসেবে এই উদ্ধার প্রক্রিয়ায় বুধবার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংকটি পরিচালনার জন্য অস্থায়ীভাবে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ এবং ইসলামী ব্যাংকের সহযোগীদের কাছে থাকা সমস্ত শেয়ারও সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে এবং ব্যাংকের কাছে গ্রুপের দায় মেটাতে সেই শেয়ারগুলি পরে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
ব্যাংকের টাকা উদ্ধারে ছাড় নেই: গভর্নর
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তিনি বলেন, “যাঁরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তাঁদের ছাড় দেওয়া হবে না। টাকা উদ্ধারে আইনগত যত পন্থা আছে, সবই অনুসরণ করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলো নিয়েও একই সিদ্ধান্ত হবে।”
এ সময় সাংবাদিকরা গভর্নরের কাছে জানতে চান যেসব ব্যাংকে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে, সেসব ব্যাংক কীভাবে পরিচালিত হবে?
জবাবে তিনি জানান, সরকার কোনো ব্যাংকের দায়িত্ব নেবে না। আপাতত স্বতন্ত্র পরিচালক দিয়ে ব্যাংকগুলো চলবে। এস আলম গ্রুপ ছাড়া অন্যদের হাতে ২ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকলে পরে তাঁরা পর্ষদে আসতে পারবেন।
এস আলম গ্রুপের কাছে কত ঋণ আছে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, “নামে-বেনামে কত ঋণ আছে, তা জানা যায়নি। বেনামি ঋণের তথ্য এখনো আমাদের কাছে নেই। তবে এসব তথ্য বের হয়ে আসবে। এ জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন।”
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য ব্যাংকের বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আভাস দিয়েছেন মনসুর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশের বেশি শেয়ার এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগীদের হাতে রয়েছে, যার অধিকাংশেই বেনামে এবং জোরপূর্বক অধিগ্রহণ করা।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ইতোমধ্যে এস আলম গ্রুপ ও এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের শেয়ার হস্তান্তর বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং ফজলে কবিরের সময় এস আলম গ্রুপ অসংখ্য বেনামি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।
গত ১৯ আগস্ট দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বহুল সমালোচিত এস আলম গ্রুপ। নামে-বেনামে শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৫ হাজার কোটি টাকা। যার বেশির ভাগই পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। সরেজমিন অনুসন্ধান, ইসলামী ব্যাংকের নথি পর্যালোচনা ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।”
অপর দিকে ২০ আগস্ট প্রকাশিত ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৭ থেকে এই বছরের জুনের মধ্যে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা নিয়েছে, যার ৭৯ শতাংশ নেয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে।
এর মধ্যে ঋণ হিসেবে নেয়া অনেক টাকা আত্মসাৎ হয়ে হয়েছে বলে ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংকের। কারণ ঋণের বড় অংশই দেশের মধ্যে ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা হয়নি।
২০১৭ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের মোট এক দশমিক ছয় বিলিয়ন শেয়ার রয়েছে, যার মধ্যে ৮২ শতাংশ বা বর্তমান বাজারদরে পাঁচ হাজার ১৬২ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার এস আলমের হাতে।
ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী কোন ব্যাবসায়িক গ্রুপ এককভাবে একটি ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশী শেয়ারের মালিক হওয়ার বিধান না থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতোদিন এস আলমের তৎপরতা নিয়ে কোন কথা বলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের অন্যতম মুখপাত্র আকিজ উদ্দিন কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
২০১৭ সাল থেকে এস আলম গ্রুপ আরও পাঁচটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এই ব্যাংকগুলো হচ্ছে—সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন সব ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত শিগগিরই শুরু হতে পারে।
শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব উদ্যোগ ইতিবাচক: বিশেষজ্ঞ
ব্যাংকিং খাতে বৃহত্তর আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মনসুর উল্লেখ করেছেন যে এই সমস্যাগুলির সমাধান করতে সময় লাগবে এবং দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে না।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফোকাস এখন অর্থনীতি রক্ষা, খেলাপি রোধ এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক লেনদেন স্থিতিশীল থাকা নিশ্চিত করা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা খুবই ইতিবাচক।
“ব্যাংকিং খাতে সমস্যা অনেক, এস আলম সমস্য তৈরি করেছে মস্তিস্কে। এখন যেহেতু সেখানেই হাত দেয়া হয়েছে আমি আশা করি মানুষের আস্থা ফিরবে,” বলেন তিনি।
তিনি মনে করেন, সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এবং কাজের স্বাধীনতা পেলে যোগ্য ব্যক্তিরা ব্যাংকগুলোকে ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে।