বিসিআইএম করিডর: রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনায় চীনের প্রস্তাবে সম্মত সদস্য দেশগুলো

পরিতোষ পাল
2017.04.26
কলকাতা
বিসিআইএমের স্টাডি গ্রুপের কলকাতা বৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বিসিআইএমের স্টাডি গ্রুপের কলকাতা বৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ২৫ এপ্রিল, ২০১৭।
বেনারনিউজ

প্রস্তাবিত বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্প কার্যকর করতে আন্ত:সরকার সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে চীন। গত ২৫-২৬ এপ্রিল কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিসিআইএম ফোরামের যৌথ স্টাডি গ্রুপের তৃতীয় বৈঠকে প্রকল্পের রোডম্যাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় চীনের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে সদস্যদেশগুলো।

চীনের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াঙ জিয়াওতাও বলেন, “প্রস্তাবিত উদ্যোগটি যাতে সফল হয়, তা নিশ্চিত করতে আন্ত:সরকার সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে চার দেশ মিলিতভাবে যে গবেষণাপত্র তৈরি করেছে তা কাজে লাগতে পারে।”

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত ও দৃঢ় হবে বলে মনে করছে বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে অভিজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজা গোপাল ধর চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “প্রস্তাবিত এই করিডর এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে বাজার যেমন সম্প্রসারিত করবে; তেমনি সড়ক, রেল, জলপথ ও বিমানপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অনেকটাই সংহত করতে পারবে।”

এই ফোরামের সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এ গীতেশ শর্মা বলেন, “চার দেশের মধ্যে সংযোগ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হলে এই অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্যের দিকেও নজর দিতে হবে।”

তাঁর মতে, “ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসি এবং উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামগ্রিক উন্নয়নে এই করিডর নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

দীর্ঘ আড়াই বছরের ব্যবধানে বিসিআইএম ফোরামের যৌথ স্টাডি গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে যৌথ স্টাডি গ্রুপের দ্বিতীয় বৈঠকের পর আলোচনা থমকে ছিল। অথচ প্রতি ছ মাস অন্তর এই স্টাডি গ্রুপের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল বলে বেনারকে জানিয়েছেন এক কূটনীতিক।

ভারতের এক সাবেক কূটনীতিক বেনারকে বলেন, “ভারতে সরকার পরিবর্তনের পরে নতুন সরকার সব প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়েই ভাবনা চিন্তা করে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর সে জন্যই বিসিআইএম আলোচনা নিয়ে ভারত ধীরে এগোতে চাইছিল।”

তিনি বলেন, “গত বছর চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার পরই এই করিডর নিয়ে আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছে।”

কলকাতার বৈঠকে জিয়াওতাওয়ের নেতৃত্বে চীনের ৩০ সদস্যের প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রঞ্জিৎ মিটার ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষে শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ ও মিয়ানমারের পক্ষে কনস্ট্রাকশন মন্ত্রকের মুখ্য প্রকৌশলী উ উইন লিউইন-র নেতৃত্ব প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।

বাংলাদেশের হাইকমিশনার হামিদুল্লাহ বলেন, “এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই করিডর বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ”

মিয়ানমারের উ উইন লিউইন বলেন, “প্রস্তাবিত করিডর এই অঞ্চলের ল্যান্ড লকড এলাকায় ব্যবসা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে।”

প্রস্তাবিত ২৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ করিডরটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের ঢাকা ও সিলেট অতিক্রম করে আবার ভারতের আসামের শিলচর ও মণিপুরের ইম্ফল হয়ে মিয়ানমারের লাসিও ও মান্দালয় ছুঁয়ে চীনের কুনমিং-এ গিয়ে শেষ হবে।
প্রস্তাবিত ২৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ করিডরটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের ঢাকা ও সিলেট অতিক্রম করে আবার ভারতের আসামের শিলচর ও মণিপুরের ইম্ফল হয়ে মিয়ানমারের লাসিও ও মান্দালয় ছুঁয়ে চীনের কুনমিং-এ গিয়ে শেষ হবে।
সৌজন্যে: বিসিআইএম স্টাডি গ্রুপ
এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির এই ধারণাটি প্রথম বাংলাদেশের অধ্যাপক রেহমান সোবহান দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন কলকাতার এক কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুবীর হালদার।

তিনি জানান, ১৯৯৯ সালে চীনের কুনমিং-এ আয়োজিত এক আলোচনায় বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীন; এই চার দেশের একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন অধ্যাপক রেহমান। এরপরেই বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য একটি স্টাডি গ্রুপও গঠন করা হয়।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে বেনাপোল হয়ে বাংলাদেশের ঢাকা ও সিলেট হয়ে প্রস্তাবিত এই করিডর ফের ভারতে প্রবেশ করবে। আসামের শিলচর ও মণিপুরের ইম্ফল হয়ে মিয়ানমারের লাসিও ও মান্দালয় ছুঁয়ে চীনের কুনমিং-এ গিয়ে শেষ হবে ২৮০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই করিডর। প্রায় ১.৪৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৪৪৪ মিলিয়ন মানুষ এই করিডরের আওতায় পড়বে।

এই করিডরের সম্ভাবনা নিয়ে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রঞ্জিৎ মিটার বেনারকে বলেন, “প্রস্তাবিত এই করিডর আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যে ফাঁক রয়েছে সেটা মেটানোর সুযোগ তৈরি করতে পারে।”

একই ধরনের আশার কথা শোনালেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “এই করিডরের পাশাপাশি চীনের সড়ক ও সমুদ্র পথে সিল্ক রুট বরাবর ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্পই ভাবিয়ে তুলেছে ভারতের মতো এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকে। তাই ভারত ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিচ্ছে।”

রাজা গোপাল ধর বলেন, “চীন সচিবালয় গঠনের মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডর নিয়ে আলোচনাকে একটি কাঠামোগত দিকে এগিয়ে নিতে চাইছে। আসলে ট্র্যাক টু পর্যায়ের আলোচনাকে ট্র্যাক ওয়ান পর্যায়ে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে চীন আগ্রহী।”

তবে ভারতের প্রতিনিধি দলের নেতা রঞ্জিৎ মিটার সতর্কতার সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, “আমরা বিসিআইএমের দেশগুলির মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে যখন জোর দিচ্ছি তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি দেশে ভিন্ন ভিন্ন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিদ্যমান এবং উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাও ভিন্ন।”

তাই তিনি পারস্পরিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করার আগে চার দেশের মধ্যে উন্নয়নের অবস্থার মধ্যে যে ফারাক রয়েছে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।