‘নতুন বাংলাদেশে’ সবার কণ্ঠে বিচার দাবি, প্রত্যাশা মানবিকতা
2024.11.19
ঢাকা
কেউ জোর দিয়েছেন সংস্কারের উপর, কেউ চেয়েছেন দ্রুত নির্বাচন, কেউ বলেছেন সন্তান হারানোর ঘটনা। তবে তাদের সবার প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণ এবং নৃশংসতার জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসকদের বিচার।
মঙ্গলবার ঢাকায় বেনারনিউজ আয়োজিত ‘কী চাই নতুন বাংলাদেশে?’ শীর্ষক ফোরাম আলোচনায় এসব দাবি উঠে আসে। শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানে কথা বলেন আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নিহতের স্বজন এবং বিগত সরকারের আমলে গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আলোচনা উপলক্ষে মিলনায়তনের বাইরের লবিতে প্রদর্শন করা হয়েছিল ছাত্র ও গণ আন্দোলনের সময় বেনারনিউজের প্রতিবেদকদের তোলা ১৪টি ছবির প্রদর্শনী।
ছবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল গুরুতর আহত গোলাম নাফিজ (১৭) নিথর দেহে শুয়ে আছে একটি রিকশার পাদানিতে। এই ছবিটিকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাফিজের মা নাজমা আক্তার নাসিমা। গত ৪ আগস্ট ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় নাফিজ।
রিকশায় থাকা অবস্থাতেও নাফিজ জীবিত ছিল জানিয়ে নাজমা আক্তার নাসিমা আলোচনায় বলেন, “গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু-পথযাত্রী আমার ছেলেকে আওয়ামী লীগের ছেলেরা হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি, তারা এতটাই নৃশংস হয়েছে।”
“নাফিজের মতো যতজন শহীদ হয়েছে সবার হত্যার বিচার হওয়া দরকার,” বলেন নাসিমা।
নাসিমার মতো সন্তান হারানো আরেক পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন আলোচনায়। তাঁর ছেলে জাহিদ হোসেন (১৯) ১৮ জুলাই মারা যায় পুলিশের গুলিতে।
নাসিমা ও জাহাঙ্গীর যখন তাঁদের সন্তান হারানোর ঘটনা বর্ণনা করছিলেন তখন মিলনায়তন জুড়ে দর্শকদের মধ্যে ছিল আবেগঘন নিস্তব্ধতা, কেউ কেউ ভেঙে পড়েছেন কান্নায়।
ছেলের লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের ভয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে মৃত ছেলেকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল বলে জানান জাহাঙ্গীর। তিনি জানান, পুলিশের ভয়ে স্থানীয় মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাঁর ছেলের লাশ দাফন করতেও রাজি হয়নি।
তিনি বলেন, “আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয়, সব মায়েরা সুখে থাকতে পারে এমন বাংলাদেশ চাই।”
এমন একটা বাংলাদেশের জন্য একটা ছেলেকে দিয়েছেন জানিয়ে দুই ছেলের বাবা জাহাঙ্গাীর বলেন, “প্রয়োজনে আরেকটা আছে। দ্বিতীয় ছেলে গেলে বাপ আছে।”
‘২৪ এর স্বাধীনতা’
তিন পর্বের অনুষ্ঠানের মূল পর্ব ফোরাম আলোচনা সঞ্চালনা করেন বেনারনিউজের সিনিয়র কন্টেন্ট ম্যানেজার আশীফ এন্তাজ রবি।
আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার বিচার এবং আগামীতে নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের প্রসঙ্গ।
আগস্টের ৫ তারিখ গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে বাংলাদেশের অন্যতম ‘স্বাধীনতা’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন আলোচকেরা।
অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, “৪৭ এর স্বাধীনতা আমাদের প্রথম স্বাধীনতা, ৭১ এর স্বাধীনতা দ্বিতীয় স্বাধীনতা।”
চলতি বছরের অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতকে “তৃতীয় স্বাধীনতা” হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “ইতিহাস বিকৃতি বাংলাদেশে ৭২ সালেই শুরু হয়েছিল। …চুরি হওয়া স্বাধীনতা ২৪-এ পুনরুদ্ধার হয়েছে।”
অভিনয়শিল্পী নওশাবা আহমেদ বলেন, “৫ আগস্ট আমার মনে হয়েছে আমরা আসলেই স্বাধীন। এখন সবার বাংলাদেশ চাই। কেউ দুস্থ থাকবে না। সবার কথা শুনতে হবে।”
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পক্ষে একটি লাইভ করার কারণে গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হন নওশাবা।
আগে বিচার
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, “রক্তের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ, সেখানে আগে বিচার দেখতে চাই। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসতে পারবে কি না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাকডোর দিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার রাজনীতি করলে আমরা শহীদ হতে রাজি আছি। মনে রাখবেন, আমরা তাদের দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করেছি।”
আওয়ামী লীগ শাসানের বিগত ১৫ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীরাই সবচে বেশি হত্যা, গুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, “বিচার আগে হতে হবে।”
আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়ে আলোচকদের সাথে একমত পোষণ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “যাদের হাতে রক্ত আছে তাদের আগে বিচার করতে হবে। কেউ পার পাবে না।”
অনুষ্ঠান শেষে প্রশ্নত্তোর পর্বে দর্শক সারি থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের কাছে নিহত গোলাম নাফিসের বাবার সরাসরি প্রশ্ন ছিল, “বিচার কত তাড়াতাড়ি করতে পারবেন?”
জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব করব এবং ভালোভাবে করব।” তবে বিচার নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে সেজন্য অতিমাত্রায় তাড়াহুড়া করা হবে না বলে জানান তিনি।
নির্বাচন প্রসঙ্গ
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিনসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকের কণ্ঠেই নির্বাচনের তাগিদ বড়ো হয়ে আসে।
নির্বাচন, না সংস্কার, কোনটি অগ্রাধিকার পাবে তা নিয়ে দুই রকম মতামত অনুষ্ঠানে কিছুটা বিতর্কের আবহ তৈরি করে।
অনুষ্ঠানে একজন ছাত্রের প্রশ্ন ছিল, “২০১৮ সালে ভোটার হয়েছি। আজ পর্যন্ত ভোট দেওয়ার সুযোগ পাইনি। আমি আমার ভোট কবে দিতে পারব?”
এ প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, “নির্বাচনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। নতুন বাংলাদেশ মেরামতে লক্ষে ৬টি কমিশন হয়েছে। তারা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতে পরের ধাপে যেতে হবে।”
বিএনপির মাহদী আমিন বলেন, “আন্দোলনের সময় সংস্কারের কোনো প্রশ্ন কারো সামনে ছিল না। সবার লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা চাচ্ছি বেসিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন হলে তারপর নির্বাচন। অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো ‘নির্বাচিত’ অজুহাত দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করেছে। ফ্যাসিস্ট হয়ে গেছে। আর যেন এমন না হয়।”
‘মানবিক বাংলাদেশ’ চাই
আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে বেনারনিউজের হেড অব নিউজ শরিফুজ্জামান পিন্টু চার বছর যাবত বেনারনিউজের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে ব্লক করে রাখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বেনারনিউজের সাংবাদিক আহম্মদ ফয়েজের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগ আমলে ৪৪ দিন গোপন বন্দিশালায় কাটানো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোবাশ্বার হাসান।
মোবাশ্বার বলেন, “মানবিক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে গুম, খুন হবে না। ক্ষমতায় এসে কোনো সরকার তা করতে চাইলেও জনগণ তা প্রতিহত করবে। সবাই একে অপরকে মানবিক মর্যাদা দেবে।”
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে জেসমিন পাপড়ির সঞ্চালনায় বেনারনিউজের সাংবাদিক সুদীপ্ত সালাম, শরীফ খিয়াম ও জীবন আহমেদ গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তাদের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাঁচ শতাধিক দর্শক। প্রশ্নোত্তর পর্বে যাদের অনেকেই আগস্ট আন্দোলন নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার পাশাপাশি আলোচকদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠান শেষে একজন দর্শক জিয়াউর রহমান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “অনুষ্ঠানটা ছিল খুবই সফল, সাবলীল ও মনে রাখার মতো।”