গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু

আহম্মদ ফয়েজ
2022.01.10
ঢাকা
গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই অ্যালুমিনিয়ামের বাসন তৈরির কারখানায় কাজ করছেন এক শ্রমিক। ২২ ডিসেম্বর ২০২১।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গত বছর বিভিন্ন খাতের কমপক্ষে এক হাজার ৫৩ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, যার প্রায় অর্ধেকই পরিবহন খাতে। পাশাপাশি ওই সময় কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন আরো ১৪৭ শ্রমিক।

“বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদপত্র ভিত্তিক বিলস্ জরিপ-২০২১” এ রোববার এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস্)।

বিলস্ এর তথ্যমতে, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন সেক্টরে ৭৯৩ শ্রমিক মারা যান এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান ৩১৬ জন।

এতে বলা হয়, “বিভিন্ন সেক্টরে ৪৩১টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ১৭২টি শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে তৈরি পোশাক খাতে।”

জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে এক হাজার তিন জন পুরুষ এবং ৫০ জন নারী শ্রমিক।

“খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৫১৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে,” জরিপে বলা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ২৮৬ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন, যাঁদের ১৪৭ জন মারা যান।

নির্যাতনের শিকার শ্রমিকদের মধ্যে ২৩২ জন পুরুষ এবং ৫৪ জন নারী শ্রমিক। যাদের মধ্যে সর্বাধিক পরিবহন খাতের ৯৯ শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন।

এ ছাড়াও ২০২১ সালে তিনশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের বাইরে নির্যাতনের শিকার হন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। কর্মক্ষেত্রের বইরে সবচেয়ে বেশি ৮৭ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন তৈরি পোশাক শিল্প খাতে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০২১ সালে বিভিন্ন সেক্টরে সব মিলিয়ে ৪৩১টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে,” এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭২টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে তৈরি পোশাক খাতে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫০টি পরিবহন খাতে এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৬টি পাট শিল্প খাতে।

“এছাড়া গণমাধ্যমে ২৩টি, কৃষি খাতে ২১টি, চিনি শিল্পে ১৮টি, টেক্সটাইল শিল্পে ১২টি, বিড়ি শিল্পে ৯টিসহ অন্যান্য খাতে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে,” উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলন করতে গিয়ে এসময়ে এক জন নারী শ্রমিকসহ ছয় জন শ্রমিক নিহত এবং ১৬৩ জন শ্রমিক আহত হন।

আহতদের মধ্যে ১২২ পুরুষ এবং ৪১ জন নারী শ্রমিক ছিলেন। আহতদের ১৩৭ জন তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক।

বকেয়া বেতনের দাবিতে ১২৬টি শ্রমিক অসন্তোষ

গত বছর কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস লিমিটেডের সেজান জুস কারখানায়। এই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫২জন শ্রমিক।

ওই ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোড়ন তৈরি করে এবং কারখানাগুলোতে দুর্বল নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। তার প্রেক্ষিতে বাইরের কল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্নি-দুর্ঘটনাসহ কর্মপরিবেশ সম্পর্কে জানতে দেশব্যাপী প্রায় চল্লিশ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

এই পরিদর্শনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “পরিদর্শন দলগুলোর জন্য যে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিলো তা গতকাল (রোববার) শেষ হয়েছে। সারা দেশে মোট এগারোটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়।”

তিনি বলেন, “গত বছরের পর থেকে আমরা ইতোমধ্যে আট শতাধিক কারখানা পরিদর্শন করেছি। তবে পরিদর্শনে কী পেয়েছি সেটা আমরা এখনি প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।”

করোনার এই বছরে শ্রমিক অসন্তোষ থেমে ছিল না। গত বছর সর্বোচ্চ ১২৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বকেয়া বেতনের দাবিতে।

এ ছাড়া দাবি আদায়ে ১১৫টি, অধিকার আদায়ে ৭৪টি, বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে ২৭টি, লে-অফের কারণে ২৬টি, ভাতার দাবিতে ২২টি, বোনাসের দাবিতে ১৬টি, এবং অন্যান্য দাবিতে ২৯টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে বিভিন্ন সেক্টরে সবমিলিয়ে ৫৯৩টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ২৬৪টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে তৈরি পোশাক খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৯টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে পাট শিল্পে।

বিলস্ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং শারীরিক নির্যাতন।

কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে পুরাতন লোহা কাটার কাজ করে যাচ্ছেন এক নারী শ্রমিক। ২২ ডিসেম্বর ২০২১। [সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]
কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে পুরাতন লোহা কাটার কাজ করে যাচ্ছেন এক নারী শ্রমিক। ২২ ডিসেম্বর ২০২১। [সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

সংবাদ না হওয়ায় অনেক ঘটনা জরিপে আসছে না

গত বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর মহাপরিদর্শক মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিলস্ এর প্রতিবেদনটি আমরা দেখিনি। না দেখে এই সংখ্যা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”

“তবে আমরা সারা দেশের কলকারখানগুলোয় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। নির্যাতনের কোনো ঘটনা আমাদের নজরে আসলে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি,” যোগ করেন নাসির উদ্দিন।

শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গৌতম কুমার বেনারকে বলেন, “আমরা শ্রমিকদের মানবাধিকার ও ওয়েলফেয়ারের জন্য কাজ করছি। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হলে বা নির্যাতিত হলে আমার সেই শ্রমিকদের পাশে দাড়াই।”

“শ্রমিকদের আমরা স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য প্রশিক্ষিত করে যাচ্ছি,” যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) সভাপতি কল্পনা আখতার বেনারকে বলেন, “বিলস্ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা বাস্তব চিত্রের যথার্থ প্রতিফলন। তবে সংবাদ না হওয়ায় এমন আরো অনেক ঘটনা জরিপে আসছে না।”

তিনি বলেন, “নির্যাতন ও তথাকথিত দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেই এই ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সরকারের উচিত শ্রমিক হত্যার প্রতিটি ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।”

তিনি অভিযোগ করেন, দেশের সার্বিক ব্যবস্থা সবসময়ই মালিক বা নির্যাতনের সাথে জড়িতদের পক্ষে কাজ করে। যার ফলে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে সব সময়ই বঞ্চিত থাকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।