চার দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি ভবন বিস্ফোরণ, একটিরও কারণ জানা যায়নি

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.08
ঢাকা
চার দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি ভবন বিস্ফোরণ, একটিরও কারণ জানা যায়নি ঢাকার গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ভবন ধসের ঘটনায় নিখোঁজ সন্তানের ছবি উদ্ধারকর্মীদের দেখিয়ে তাঁকে খোঁজার আকুতি জানাচ্ছেন একজন মা। ৮ মার্চ ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

গত চার দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি বড়ো বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে কমপক্ষে ২৯ জনের, আহত দুই শতাধিক। তবে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, সেসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি।

এসব বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছে। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে জনগণ, বাড়ছে উদ্বেগ। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠেছে।

সর্বশেষ ৭ মার্চ বিকেলে ঢাকা মহানগরীর সিদ্দিকবাজার এলাকায় সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটায় বুধবার পর্যন্ত ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

এর আগে গত ৫ মার্চ ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়ে প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের পাশের তিন তলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটলে প্রাণ হারান অন্তত তিন জন।

এ ছাড়া ৪ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের’ প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ছয় ব্যক্তি।

প্রত্যেকটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সাধারণত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয় না, অথবা প্রকাশ হলেও প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না।

‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড’

সংশ্লিষ্টদের মতে, ভবনে এই ধরনের বিস্ফোরণ প্রকারান্তরে ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড’। এ জন্য নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবহারকারী উভয় পক্ষ দায়ী।

সুশীল সমাজের সদস্য স্থপতি ইকবাল হাবিব বুধবার বেনারকে বলেন, “দেশে ঘন ঘন ভবন বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে সব নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করা।”

তিনি বলেন, “ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলো; যেমন ঢাকায় রাজউক অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ বন্ধ করতে পারেনি। কখনো কখনো তারা অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণে বরং সহায়তা করেছে।”

ইকবাল হাবিব বলেন, “আবার নির্মাণকারী ও ব্যবহারকারীরাও তাদের সুবিধার জন্য ভবন বড়ো করেছেন। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেননি। সেই কারণে আমি বলব, এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনা নয়। রাজউক যদি তার দায়িত্ব পালন করত তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয় না, তদন্ত হলেও পরে তা চাপা পড়ে যায়।”

“বাংলাদেশে বিল্ডিং কোড প্রণয়ন হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি এই কোড বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্তৃপক্ষও করা হয়নি,” বলেন তিনি।

IMG_2948.jpg
ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ভবন বিস্ফোরণের দ্বিতীয় দিনে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার উদ্ধার অভিযান। ৮ মার্চ ২০২৩। [বেনারনিউজ]

নিহত ২০, আহত ১৫০

মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সিদ্দিকবাজার এলাকায় ক্যাফে কুইন নামে ভবনে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।

এতে সাত তলা ভবনের সামনের অংশ পুরো উড়ে যায়। সেখানকার স্যানেটারি মালামাল ও কাঁচের টুকরা সামনের ভবন এবং সিদ্দিকবাজারের ব্যস্ত সড়কের সামনে আটকা থাকা যানবাহনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের আহত করে। বেশ কয়েকজন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান, আহত হন প্রায় ১৫০ মানুষ। গতকাল দুটি লাশ উদ্ধার হওয়ায় মৃতের সংখ্যা ২০ বলে জানিয়েছে দমকল বিভাগ।

ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে উদ্ধার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বুধবার দুপুর ২টার দিকে আবার উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। তবে ভবনের ভেতরে আটকে পড়া ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা।

যা বলছে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ

ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‍্যাব, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক দিনমণি শর্মা বুধবার বেনারকে বলেন, “ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বিস্ফোরণের কারণ বলা যাবে না।”

মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, “ভবনে জমে থাকা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বিস্ফোরণটি সায়েন্স ল্যাব এলাকার বিস্ফোরণের ঘটনার মতোই।”

রাজউক পরিচালক (জোন-৫) হাফিজুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “ওই ভবনটি তিন তলা হওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে সেটি সাততলা হলো সেই ব্যাপারে কাগজ না দেখে বলা যাবে না। ছুটির দিন হওয়ায় ওই কাগজ দেখা যাচ্ছে না।”

একই স্থানে র‍্যাবের বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “ভবনের বিস্ফোরণ হয়েছে বেজমেন্ট থেকে।”

তিনি বলেন, “এটা স্বাভাবিক কোনো বিস্ফোরণ নয়, বিস্ফোরণটি শক্তিশালী। এটি গ্যাস লিকেজের কারণে হয়ে থাকতে পারে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।”

তবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের পরিচালক (অপারেশন) মো. সেলিম মিয়া বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, গ্যাসের কোনো লিকেজ নেই। আর গ্যাস লিকেজ থাকলে গ্যাস বের হতেই থাকবে এবং গ্যাসের গন্ধ বের হবে। গ্যাসের গন্ধ তো নেই।”

তিনি বলেন, “সুতরাং, আমি মনে করি গ্যাস লিকেজ থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটেনি।”

মশিউর রহমান এবং সেলিম মিয়া বলেন, “সেপটিক ট্যাংক থেকে মিথেন গ্যাস জমে সেটি অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।”

ইকবাল হাবিব বলেন, “বিভিন্ন মহানগরীতে বাসা-বাড়িতে ঘুলঘুলি থাকত। সেগুলো দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে যেত। এখনকার বাসাগুলোতে ঘুলঘুলি নেই। বাসা-বাড়ির রান্না ঘর থেকে গ্যাস বেরুতে পারে না। বিভিন্ন ভবনের সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস বের হওয়ার জন্য দু’টি পাইপ থাকত। সেগুলো দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ভবনে সেপটিক ট্যাংকের ওপর স্থাপনা করা হয়েছে। ফলে গ্যাস বের হতে পারে না।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন

প্রত্যক্ষদর্শী মো. মানিক বুধবার ঘটনাস্থলে বেনারকে বলেন, “ঘটনার সময় আমি ভবনের কিছুটা পেছন দিকে ছিলাম। সে জন্য বেঁচে গেছি। সামনে থাকলে মারা যেতাম। হঠাৎ দেখি ভীষণ জোরে শব্দ।...আমরা বুঝতে পারিনি কী হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সামনে এসে দেখি আহত মানুষ রাস্তার ওপর পড়ে আছে, কেউ কাতরাচ্ছে। কারো মাথা ফেটেছে, কারো গা পুড়ে গেছে। রাস্তায় তখন ভীষণ জ্যাম ছিল। ভবনের সামনে একটি বাস দাঁড়িয়ে ছিল। পুরো বাসের সব জানালার কাঁচ ভেঙে গেছে। রিকশা উল্টে যাত্রীরা আহত হয়ে পড়ে আছে।”

মানিক বলেন, “ওই দোকানের সামনে একজন ব্যাগ বিক্রি করত, একজন লেবু বিক্রি করত, একজন খেজুর বিক্রি করত। উনারা সবাই সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন।”

উবারচালক আনোয়ার প্রাইভেট কার নিয়ে ঘটনার সময় ওই রাস্তা অতিক্রম করছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “একটি বিরাট কংক্রিটের দলা আমার গাড়ির গায়ে লেগে রাস্তার ওপারে চলে গেল। আর একজন পাঞ্জাবি পরা দাড়িওয়ালা ব্যক্তি এসে আমার গাড়ির সামনের কাঁচের ওপর পড়লেন।”

প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক মাহবুব আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কাঁপছিল। এই ভবনের টুকরা সামনের ভবনে গিয়ে আঘাত করেছে। ঘটনার পর পুরো এলাকা ধুলার মতো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।”

একটানা উদ্ধার কাজ চলেনি

ঘটনার পরপরই গুলিস্তান কার্যালয় থেকে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তবে ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মঙ্গলবার রাত ১১টার পর উদ্ধার অভিযান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সকাল থেকে সেখানে ফায়ার সার্ভিস, র‍্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার মানুষ থাকলেও ওই ভবনে উদ্ধার কাজ শুরু হয় দুপুরের দিকে।

এর কারণ জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমণি শর্মা বেনার প্রতিবেদককে ভবনের কাছে নিয়ে যান। তিনি বলেন, “দেখুন, এই ভবনের পিলারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা যদি বেজমেন্টে ঢুকে উদ্ধার কাজ করতে যাই তাহলে ওপর থেকে ফ্লোরগুলো আমাদের ওপর পড়তে পারে।”

তিনি বলেন, “এই ধ্বংস স্তূপের নিচে কোনো মানুষ আটকা পড়ে থাকলেও বর্তমান অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়।”

বিস্ফোরণের ঘটনায় বুধবার অপমৃত্যুর মামলা করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বংশাল থানা। ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, বুধবার একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে পরে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।