ঢাকায় গার্ডার চাপায় ও আগুনে পুড়ে ১১ জনের মৃত্যু
2022.08.15
ঢাকা
ঢাকায় পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় শিশুসহ ১১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। সোমবার দুপুরে পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় একটি পলিথিন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ছয়জন মারা যান। এরপর বিকেল চারটার দিকে উত্তরায় ৪৫ টনের একটি গার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়লে ঘটনাস্থলেই পাঁচজন মারা যান।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এই দুটি দুর্ঘটনায় মোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর বেনারকে নিশ্চিত করে।
উত্তরায় যে পাঁচজন গার্ডার চাপায় মারা গেছেন তাঁরা একটি বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে কাওলা থেকে আশুলিয়া যাচ্ছিলেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহসিন।
তিনি বলেন, প্রাইভেট কারটিতে দুই শিশুসহ মোট সাতজন যাত্রী ছিলেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন নববিবাহিত পুত্রের বাবা। তিনি মারা গেছেন। তবে প্রাণে বেঁচে গেছেন নব বিবাহিত দম্পতি রিয়া (২১) ও হৃদয় (২৫)।
নিহতরা হলেন হৃদয়ের বাবা রুবেল (৬০), হৃদয়ের শাশুড়ি ফাহিমা (৪০), কনে রিয়া মনির খালা ঝরনা (২৮), ঝরনার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)।
সোমবারের দুর্ঘটনা সহ এই নিয়ে বাস র্যাপিড কোম্পানির একই কাজ করতে গিয়ে তিনবার গার্ডার অথবা ক্রেন পড়ে প্রাণহানি ঘটল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রকল্পের কাজের অংশ হিসাবে রাস্তার ওপর থেকে ৪৫ টনের গার্ডার তুলে ওপরের বিমে বসাচ্ছিলেন ক্রেনের চালক। তবে সেসময় নিচ দিয়ে যানবাহন চলাচল করছিল। বিকেল চারটার দিকে হঠাৎ গার্ডারটি পড়ে চলন্ত ওই প্রাইভেট কারটি দেবে যায় এবং ঘটনাস্থলেই পাঁচ ব্যক্তি মারা যান।
চিৎকার কান্নাকাটি শুরু হলে আশেপাশের মানুষ দৌড়ে গিয়ে সেখান থেকে মানুষদের উদ্ধার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে গাড়িটির একপাশ কেটে নব বিবাহিত দম্পতিকে বের করে আনা হয়। তাঁদের উত্তরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাঁরা ভালো আছেন বলে জানান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহসিন।
ঢাকা শহরের সাথে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের যোগাযোগ উন্নত করতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প। গাজীপুরের থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বিশ কিলোমিটার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু সেই কাজের মেয়াদ বার বার বৃদ্ধি করা হয়।
চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুয়া গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের মোট খরচ ৮৫৫ কোটি টাকার বেশি বলে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির ওয়েব সাইটে জানান হয়েছে।
এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি লেনে শুধুই বাস চলাচল করবে এবং যাত্রীরা সহজেই বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চলাচল করতে পারবেন।
তবে এই প্রকল্পে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঠিক একমাস আগে প্রকল্পের গাজীপুর অংশে ক্রেন পড়ে একজনের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়াও গত বছর মার্চ মাসে উত্তরা অংশে আব্দুল্লাহপুরে গার্ডার ভেঙ্গে ছয় শ্রমিক আহত হন।
গার্ডারটি কেন নিচে পড়ে গেলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগে প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বেনারকে বলেন, গার্ডারটি তোলার সময় ক্রেনটি হেলে পড়ে এবং গার্ডারটি চলন্ত গাড়িটির ওপর পড়ে।
তিনি বলেন, “ক্রেনের চালক পালিয়ে যাওয়ায় বলা যাচ্ছে না কী ঘটেছিল।”
চকবাজারে অগ্নিকাণ্ড
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর ফায়ার ফাইটার মাহফুজ বেনারকে বলেন, দুপুর ১২টার পর চকবাজারের তিন নম্বর দেবীদ্বার ঘাট সংলগ্ন ‘ঢাকা প্লাস্টিক’ নামের একটি পলিথিন কারখানায় আগুন লাগে।
খবর পেয়ে দমকল বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর সেখান থেকে ছয়টি লাশ উদ্ধার করেন তাঁরা।
মাহফুজ বলেন, “লাশগুলো সবই পুরুষ। তবে পুড়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। আমরা লাশগুলো হাসপাতালে পাঠিয়েছি।”
দায়-দায়িত্ব সরকারের এবং কোম্পানির
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নজরুল ইসলাম সোমবার বেনারকে বলেন, “পুরাতন ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এইবারই প্রথম নয়। এর আগেও দুটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বহু প্রাণহানি ঘটেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আমরা অনেক সুপারিশ করেছি। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি।”
তিনি বলেন, “পুরান ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল ঘনবসতি। সেখান থেকে দাহ্য পদার্থ এবং বিপজ্জনক কারখানা সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই সবাই ভুলে যায় এবং কর্তৃপক্ষ আর কোনো ব্যবস্থা নেয় না।”
উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের গার্ডার পড়ে পাঁচজনের মৃত্যুর ব্যাপারে তিনি বলেন, “এই প্রকল্পের কাজ যাচ্ছেতাইভাবে করা হচ্ছে। আমি নিজেও বিভিন্ন সময় ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করেছি। কোনো প্রকার সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এত বড়ো প্রকল্প, বিরাট কোম্পানি কাজ করছে। কিন্তু জনগণের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।”
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “গত বছর একই প্রকল্পের এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এরপরও কোনো প্রকার সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যা দুঃখজনক।”
তিনি বলেন, “এই রকম মেগা প্রকল্পে যা করা উচিত সেটি হলো যেখানে কাজ চলবে সেই জায়গা দিয়ে সকল প্রকার যানবাহন এবং পথচারী চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। সেটি করা হয়নি। আর সে কারণেই এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি।”
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “উত্তরায় গার্ডার পড়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রাণহানি দায়-দায়িত্ব সরকারের এবং যে কোম্পানি কাজ করছে তাদের। কোম্পানি ন্যূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়নি। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেটি তদারকি করেনি।”