গার্ডার চাপায় ৫ মৃত্যু: চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা
2022.08.16
ঢাকা
চায়না গেজুয়া গ্রুপ কর্পোরেশনের (সিজিজিসি) মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়টিকে ‘মর্মান্তিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি
মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ. মান্নান। এ ঘটনায় মঙ্গলবার চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে।
সোমবার উত্তরার জসিমউদ্দিন সড়কের কাছে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজের সময় ৪৫ টনের একটি গার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়লে ঘটনাস্থলেই পাঁচ ব্যক্তি নিহত হন, যাঁদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে।
এই ঘটনার বিচার চেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুয়া গ্রুপ কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং জনগণের সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নিহতদের আত্মীয় মো. আরফান মন্ডল বাবু।
চায়না গেজুয়া গ্রুপ কর্পোরেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত বিআরটি প্রকল্পে এর আগে দুটি দুর্ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিষয়টি মর্মান্তিক: প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরায় গার্ডার পড়ে এতগুলো মানুষের মৃত্যুতে খুবই মর্মাহত হয়েছেন।
মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে খুবই মর্মান্তিক হিসাবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই ঘটনার একটি সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোহসিন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, গার্ডার পড়ে নিহত পাঁচজনের আত্মীয় আরফান মন্ডল বাবু সোমবার রাতে মামলা করেছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ এবং ৩৩৮ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মোহসিন বলেন, ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অবহেলাজনিত মৃত্যু এবং ৩৩৮ ধারায় জখম করার অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, তবে অভিযোগকারী চীনা ঠিকাদার কোম্পানির নাম উল্লেখ করেছেন, কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেননি। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
মোহসিন বলেন, গার্ডারটি যে ক্রেন দিয়ে তোলা হচ্ছিল সেই ক্রেনের চালকের নাম আল আমিন, তিনি পলাতক।
চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ব্যাপারে মন্তব্য জানতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
মেগাশহর ঢাকার সাথে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের যোগাযোগ ঝামেলামুক্ত করতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয় ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড, যারা এই কাজের বাস্তবায়ন তদারকি করছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গাজীপুর থেকে একটি লেন দিয়ে বাস দ্রুত গতিতে ঢাকা চলে আসবে। সেখানে অন্য কোনো যান চলবে না।
প্রকল্পের প্রথম অংশের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ২০ কিলোমিটার।
গাজীপুর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রকল্পের কাজ ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
তিন দফায় খরচ বৃদ্ধির পর বর্তমান খরচ চার হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একইসাথে কাজের মেয়াদ বার বার বৃদ্ধি করা হয়।
সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বারবার প্রশ্ন
বিআরটি প্রকল্পটির সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। গত ১৫ জুলাই প্রকল্পের গাজীপুর অংশে ক্রেন পড়ে এক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। তবে সেটি নিয়ে কোনো মামলা হয়নি।
এ ছাড়া গত বছর ১৪ মার্চ উত্তরা অংশে আব্দুল্লাহপুরের কাছে গার্ডার তোলার সময় একটি গার্ডার ভেঙে পড়ে। ওই ঘটনায় তিন চীনাসহ মোট ছয় শ্রমিক আহত হন। তবে কোনো প্রাণহানি হয়নি।
ওই ঘটনা তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করে সড়ক বিভাগ। কিন্তু সেই তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিআরটি প্রকল্পের কাজে আমার মনে হয় দুটি দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার ছিল। প্রথমটি হলো; গার্ডারটি পিয়ারে বসানোর সময় সেটি ডানে, বামে, ওপরে নিচে বিভিন্ন দিকে চলে যাবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে যে পর্যন্ত সেটি যেতে পারে সেই পুরো এলাকাটি যানবাহন ও মানুষের চলাচল বন্ধ রাখতে হতো। সেটি করা হয়নি।”
তিনি বলেন, “আরেকটি বিষয়টি হলো, আমি যতটুকু দেখলাম সেখানে দেখা যাচ্ছে ক্রেন দিয়ে তোলার সময় গার্ডারটি উল্টে গেছে। এর অর্থ হলো, ক্রেনটির ধারণ ক্ষমতা গার্ডারটি তোলার সমান ছিল না। ক্ষমতা সঠিক থাকলে উল্টে যেত না।”
চীনা কোম্পানির পক্ষ থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থার কোনো ঘাটতি ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক রশীদ বলেন, “একটি প্রকল্পে যখন বার বার বিভিন্ন রকমের দুর্ঘটনা ঘটে তখন সেই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করাটাই স্বাভাবিক।”
তিনি বলেন, “যেহেতু বিআরটি প্রকল্পে এর আগে আরও দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে সেহেতু মানুষ বিশ্বাস করে যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়নি।”