করতোয়ায় নৌকাডুবি: ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার, এখনো নিখোঁজ ৪

আহম্মদ ফয়েজ
2022.09.27
ঢাকা
করতোয়ায় নৌকাডুবি: ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার, এখনো নিখোঁজ ৪ পঞ্চগড়ে নৌকাডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার সকালে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি মৃতদেহ উদ্ধার হলে লাশটির কাছে ছুটে যান অপেক্ষমাণ স্বজনরা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় তৃতীয় দিনে আরো ১০টি মৃতদেহ উদ্ধারের পর মঙ্গলবার নারী-শিশুসহ মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৬৮ জন। এই ঘটনায় আরো চারজন নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

নিখোঁজ চারজনের সন্ধানে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে জানিয়ে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর কুমার রায় বেনারকে বলেন, “পঞ্চগড়ের সবগুলো থানা ও আশপাশের জেলা-উপজেলাগুলোকে নিখোঁজ চারজনের বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়েছে।”

মৃতদের মধ্যে একমাত্র ডুবে যাওয়া নৌকার মাঝি ছাড়া সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনিয়ে তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া মৃতদের মধ্যে ৩০ জন নারী, ২১ জন শিশু ও ১৭ জন পুরুষ।

এদিকে এই নৌ দুর্ঘটনার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক ইমরান উদ্দীন বেনারকে বলেন, “এই দুর্ঘটনার দায় কোনো কর্তৃপক্ষই নিতে চাইবে না, এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি। কিন্তু এর পেছনে স্থানীয় প্রশাসন কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।”

করতোয়ায় যে নৌকাটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে সেটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, তার কোনো ভিত্তি নেই জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “ওই নৌকাটির ধারণক্ষমতা কত বা কত হওয়া উচিত তার কিছুই বলা সম্ভব না, কারণ এসব নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়ম নীতি নেই।”

“তবে এটা সত্য যে প্রতিটি ঘাট ইজারা থেকে যেহেতু সরকার রাজস্ব পায়, তাই এসব নৌযানে চলাচলে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল করতে হবে,” বলেন তিনি।

এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে দীপঙ্কর বেনারকে বলেন, “দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। আমরা তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানাব।”

উদ্ধার অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস যৌথ উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাবে। নদীতে প্রবল স্রোতের ফলে মৃতদেহ ৮০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত চলে গেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।

শতাধিক হিন্দু পুণ্যার্থী নিয়ে বোদা উপজেলার করতোয়া নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি ডুবে যায় রোববার দুপুরে।

অপেক্ষা যখন শুধুই লাশের

নৌকাডুবির তৃতীয় দিনে এসেও যেসব স্বজন করতোয়া নদীর পারে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা কেউই প্রত্যাশা করেননি যে হারিয়ে যাওয়া স্বজন জীবিত ফিরবেন। তাঁদের অপেক্ষা ছিল শুধুই লাশের জন্য।

মঙ্গলবার সকালে উদ্ধারকারীরা যখন নদীর ঘাটে কাদায় আটকে থাকা হরি কিশোরের লাশ উদ্ধার করেন, তখন পরিবারের পাঁচ সদস্য হারানো স্বপন কুমার রায়ের জন্য বিষয়টি ছিল কিছু স্বস্তির।

“আমি এখন আমার ভাগিনা-ভাগ্নিদের সান্ত্বনা দিতে পারি যে তারা তাদের বাবা-মা উভয়ের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আমি কীভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেবো,” করতোয়া পারের মাড়েয়া আউলিয়া ঘাট থেকে ফোনে বেনারের কাছে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন স্বপন।

মঙ্গলবার রাতে আলাপকালে তিনি জানান, তিনি তার বাবাসহ পরিবারের চার সদস্যদের লাশ পেলেও বোনের খোঁজ পাননি তখনো।

নৌকাডুবির ঘটনায় সাত বছরের মেয়ে দেবশ্রী রায়কে হারিয়ে দিনমজুর পিতা নারায়ণ চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে বলেন, এই এলাকায় নদী সাধারণত শান্ত থাকে এবং বছরের পর বছর তাঁদের এলাকায় বড়ো ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

“দুর্ঘটনার একদিন আগে প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। সম্ভবত এ কারণেই স্রোত প্রবল ছিল। কিন্তু আমি মেয়েকে স্বাভাবিকভাবে আমার আত্মীয়দের সাথে যেতে দিয়েছি,” বলেন তিনি।

এসময় তিনি বলেন, মেয়ের লাশ খুঁজে পেলেও, ভাগ্নি এখনো নিখোঁজ।

দেশে প্রায়ই নৌকা দুর্ঘটনা ঘটে। কারণ ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা এবং মেঘনা নদীসহ শত শত জলপথে সাধারণ যাতায়াতের জন্য নৌকা বা অন্যান্য নৌযান ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

গত বছর তিনটি বড়ো নৌকা দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৮২ জন মারা গেছেন।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, ৩২৬টি নৌপথ দুর্ঘটনায় ৪৬২ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ৩১৫ জন এবং এসব দুর্ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন ৬৭৭ জন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।