ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলার রায় ১৬ ফেব্রুয়ারি

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.02.04
ঢাকা
ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলার রায় ১৬ ফেব্রুয়ারি জঙ্গিদের হাতে নিহত অভিজিৎ রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে হত্যাকাণ্ডের স্থানে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন নাগরিক সমাজ। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

ছয় বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে নিহত হয়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়। চাঞ্চল্যকর সেই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি। 

বৃহস্পতিবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান এই রায়ের দিন ঘোষণা করেন। বুধবার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে আজ শেষ হয়।

এরপরই মামলার তারিখ ঘোষণা করা হয় বলে বেনারকে জানান সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের কৌসুলি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির। 

বৃহস্পতিবার ছয় অভিযুক্তের মধ্যে আটক চার আসামি মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস এবং শফিউর রহমান ফারাবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। 

আটকদের মধ্যে ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী ছাড়া সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামের সদস্য। 

তবে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া ও আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ পলাতক। 

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে জঙ্গি কায়দায় হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়।

স্বামীকে রক্ষা করতে গিয়ে জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে একটি আঙুল হারান বন্যা। তবে বন্যা আহত হওয়ার ঘটনায় আলাদা কোনো মামলা হয়নি বলে বেনারকে জানান অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিৎ রায়। 

অভিজিৎ সস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। ছেলে হত্যার বিচার শেষ হওয়ার আগেই অজয় রায় মারা যান। 

অভিজিৎ রায়ের অন্যতম আলোচিত বই বিশ্বাসের ভাইরাস। বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তমনা নামের একটি ব্লগ পরিচালনা করতেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাকারীদের অভিযোগ হচ্ছে, তিনি তাঁর বইয়ে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেছেন। 

ঘটনার আগে থেকেই অভিজিৎ রায়কে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেন মামলায় অভিযুক্ত উগ্রবাদী ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী। তবে হুমকির মুখেও অভিজিৎ অমর একুশে বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন। উল্লেখ্য, অভিজিৎ ও বন্যা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। 

সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন অধ্যাপক অজয় রায়।

প্রথমে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে। ওই তদন্ত শেষ হতে চার বছরের বেশি সময় লাগে। 

২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সাক্ষী করা হয় বন্যাসহ ৩৪ জনকে। তবে বন্যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাক্ষী দিতে আসেননি। 

অভিযোগটি আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ১ আগস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার ছয় আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইবুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান।

বুধবার রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির আসামিদের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে যুক্তিতর্ক শেষ করেন। বৃহস্পতিবার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

আবু সিদ্দিক সোহেল ও আরাফাত রহমানের আইনজীবী খায়রুল ইসলাম লিটন বেনারকে বলেন, “আমি বুধবার ও বৃহস্পতিবার যুক্তিতর্কে বলেছি, এই মামলার অভিযোগপত্র ঠিক নেই, তদন্ত সঠিকভাবে হয়নি। এখানে অনেক ভুল আছে।”

তিনি বলেন, “বাদী অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় আদালতে সাক্ষী দিয়ে বলেছেন, যেসব আসামিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা কেউই তাঁর ছেলেকে হত্যা করেনি। বাদী নিজে বলেছেন, কারা তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে এবং তাঁদের নাম উল্লেখ করে জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেলো অভিযোগপত্রে ওইসব আসামির নাম নেই।”

লিটন বলেন, “আমার মক্কেলদের এক মাসের বেশি ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলোর পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।”

তিনি বলেন, “এটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন বিধায় এই নিরীহ আসামিদের এভাবে বিচার করা হচ্ছে।”

লিটন বলেন, “আমি আশা রাখি, আদালত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে আসামিদের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেবেন।” 

অভিযোগপত্রে যা বলা হয়েছে

অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ১২ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেলেও তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে মোট ছয়জনকে।

আসামিরা জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য বলে উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে। এতে বলা হয়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের মূল নেতা জিয়ার ‘নির্দেশেই’ সেদিন অভিজিৎ রায়ের ওপর হামলা হয়।

এতে আরও বলা হয়, আসামি মোজাম্মেল, আকরাম, হাসান ও আবু সিদ্দিক হত্যাকাণ্ডের দুই মাস আগে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ১৯২/২ নম্বর বাসা ভাড়া নেন। তাঁরা অভিজিৎ রায়ের চলাফেরা অনুসরণ করার এক পর্যায়ে তাঁকে হত্যা করেন।

আসামি মোজাম্মেল রেকি টিমের নেতৃত্বে ছিলেন। অপারেশন শাখার মুকুল রানা ওরফে শরিফুলের দায়িত্ব ছিল অভিজিৎ রায়ের গতিবিধি লক্ষ্য করা এবং আসামিদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশন শাখার সদস্য আসামি আরাফাত রহমান, আলী ওরফে খলিল, অনিক এবং অন্তু সাংগঠনিকভাবে দায়িত্ব পেয়ে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগপত্র বলা হয়।

এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া দলটির নেতৃত্বে থাকা মুকুল রানা ওরফে শরিফুল ২০১৬ সালের ১৯ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।