জাগৃতির প্রকাশক দীপন হত্যার দায়ে আট জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড
2021.02.10
ঢাকা

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্যই জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে জঙ্গিরা হত্যা করেছিল বলে জানিয়েছে আদালত।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর দীপন হত্যাকাণ্ডের মামলায় বুধবার এই কারণ উল্লেখ করে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান আট অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন।
“সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে,” জানিয়ে রায়ে বলা হয়, “যারা বই প্রকাশের দায়ে মানুষ হত্যা করতে পারে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু।”
রায় ঘোষণার সময় মামলায় অভিযুক্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আটক ছয় সদস্যকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
এরা হলেন, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির (২৪), আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ (২৩), খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল রিফাত (২৪), আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব সাজিদ (৩৪), মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (২৫) এবং শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়েরকে (২৭)।
এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক (৫০) ও আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব (২৮) এখন পর্যন্ত পলাতক।
রায়ের সময় মামলার বাদী দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। আদালত প্রাঙ্গণে গণমাধ্যমের সামনে মুখ খুলতে না চাইলেও ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, “প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত কোনো রায়েই আমাদের দীপন কবর থেকে উঠে আসবে না।”
তবে রায়ের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কাউকে বিমর্ষ দেখা যায়নি। আদালত থেকে কারাগারে ফিরে যাবার সময় ‘প্রিজন ভ্যানে’ তাঁদেরকে হাসিমুখে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।
রায়ে পলাতক মেজর জিয়াকে হত্যার নির্দেশ, প্রশিক্ষণ ও অর্থদাতা এবং আকরামকে পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
“তারাও এক না একদিন ধরা পড়বে,” এমনটা প্রত্যাশা করে আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন বেনারকে বলেন, “আমরা আশা করছি, উচ্চ আদালতে এই রায় পরিবর্তন হবে না এবং এটা দ্রুত কার্যকর করা হবে।”
রায়টি সঠিকভাবে কার্যকর হলে বাংলাদেশের প্রকাশকরা সব ধরনের বই প্রকাশের সাহস ফিরে পাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অভিজিতের বই প্রকাশের জন্য দীপনের খুন হওয়ার বিষয়টি রায়ে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন অভিজিৎ। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর সেই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা রয়েছে।
আপিল করবেন আসামিরা
রায়ের পর আসামি পক্ষের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আসামিরা এই রায়ে সন্তুষ্ট নয়। যে কারণে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।”
“এ জাতীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক, সেটা আমরাও চাচ্ছি। কিন্তু আসামিরা দাবি করেছে, তারা ন্যায়বিচার পায়নি,” বলেন তিনি।
আসামিদের আরেক আইনজীবী এবিএম খায়রুল ইসলাম লিটন বলেন, এই হত্যা মামলার কোনো ‘আই উইটনেস’ (চাক্ষুষ সাক্ষী) ছিল না। ১৬৪ ধারায় দেওয়া যে জবানবন্দীর ভিত্তিতে এই রায় দেওয়া হয়েছে তা আসামিদের দীর্ঘদিন আটক রেখে রিমান্ডে নিয়ে সাজানো ও শেখানো।
“এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট,”—এ কথা উল্লেখ করে আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির সাংবাদিকদের বলেন, “পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হবে।”
‘জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করা’
রায়ে বলা হয়, “ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে একদিকে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়রা মানসিক শান্তি পাবেন, অন্যদিকে ভবিষ্যতে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে অন্যরা ভয় পাবে এবং নিরুৎসাহিত হবে।”
হত্যাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল তা রায়ে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, আসামি মইনুল অস্ত্র সংগ্রহ, খুনের পরামর্শ এবং মূল হত্যাকারীদের দিক নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। মোজাম্মেল হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করেন এবং ঘটনাস্থল ‘রেকি’ করেন।
এ ছাড়া সবুর হত্যাকারীদের প্রশিক্ষণ দেন, সোহেল ও খায়রুল ঘটনাস্থল রেকি করেন এবং আবদুল্লাহ অর্থ আনা–নেওয়া করেন।
“তাদের অভিন্ন অভিপ্রায় ছিল ব্লগার, প্রকাশক ও সমকামীদের হত্যার ধারাবাহিকতায় ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা,” বলা হয় রায়ে।
“সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা সাভারে ব্লগার রিয়াদ মোর্শেদ বাবুকে হত্যা করে। একইদিনে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক টুটুলের (আহমেদুর রশীদ টুটুল) ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়,” রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারক।
“মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দেওয়া এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল জঙ্গি দলের ওই সদস্যদের লক্ষ্য,” বলেছে আদালত।

‘দীপন মারা যাওয়ার কারণটিও মনে রাখতে হবে’
“যে কোনো বিচারিক প্রক্রিয়াকে আমি স্বাগত জানাই,” মন্তব্য করে রায়ে উল্লেখিত এবং দীপন হত্যার দিন পৃথক স্থানে হামলার শিকার শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর আহমেদুর রশীদ টুটুল এক প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতার সুরক্ষা প্রতিষ্ঠার ক্ষমতার উপর এই রায়টির চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করবে।”
দীপন মারা যাবার মূল কারণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাব, সেটিও “মনে রাখতে হবে” জানিয়ে টুটুল বলেন, “যেদিন আর কারো ওপর আক্রমণ করা হবে না এবং বই প্রকাশ বা মত প্রকাশের জন্য কাউকে ভয়ে ভয়ে বাঁচতে হবে না, সেদিনই আমরা প্রকৃত স্বস্তি পাব।”
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর দুর্বৃত্তরা আজিজ সুপার মার্কেটে দীপনকে কুপিয়ে হত্যার পর ওই দিন রাতেই তাঁর স্ত্রী জলি শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ জানুয়ারি রায়ের দিন ধার্য করেন বিচারক।