আদালত: স্বাধীন মত প্রকাশের জন্যই অভিজিৎ রায় হত্যা, ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড
2021.02.16
ঢাকা

স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে- এমন মন্তব্য করে বিচারক বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যরা তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
মঙ্গলবার ছয় বছর আগের চাঞ্চল্যকর অভিজিৎ হত্যা মামলার রায় প্রকাশের সময় বিচারক এ কথা উল্লেখ করেন। রায়ে পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি হত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বেনারকে বলেন, “অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হলো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।”
রায়ে আনসার আল ইসলামের (পরে এবিটি নামে পরিচিতি) সামরিক শাখার প্রধান ও সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক (৪২), জঙ্গি নেতা আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান (৩০), আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব(৩৪), মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (২৫) এবং আরাফাত রহমান ওরফে সিয়ামকে (২৪) মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
“অভিজিৎ রায় হত্যায় অংশ নেওয়া অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাহিরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে এবং বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা লেখকরা স্বাধীনভাবে লিখতে এবং মতামত প্রকাশ করতে সাহস পাবে না। কাজেই ওই আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারে না,” বলেন বিচারক।
একই রায়ে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ‘প্ররোচনাকারী’ হিসেবে ইসলামি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
“ফারাবী এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিল, এই অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা কি আমাদের মুসলিমদের জন্য ফরজ না? সেই হিসেবে তাঁকে হত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে আদালত যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে,” বলেন আইনজীবী জাকির।
দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে জিয়াউল ও আকরাম পলাতক। বাকি চার আসামির উপস্থিতিতেই রায় পড়ে শোনান বিচারক।
এদের মধ্যে জিয়া, আকরাম, সোহেল ও সায়মনকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায়ের বইয়ের অন্যতম প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যায় দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে একই আদালত।
অভিজিৎ ও দীপন হত্যায় মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত চারজন ছাড়াও আরাফাত সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন রূপবান এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে হত্যাকাণ্ডেরও অভিযোগপত্রভু্ক্ত আসামি।
রায়ের সময় অভিজিৎ রায়ের কোনো স্বজন আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে শুধু সায়মনের বাবা আবু মোহাম্মদ হুসাইন উপস্থিত ছিলেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম।
আদালত প্রাঙ্গণে আলাপ করতে চাইলে আবু মোহাম্মদ হুসাইন বেনারকে বলেন, “এই উদ্ভট রায় নিয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না।”
মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে অভিজিৎ রায়ের ভাই অনুজিৎ রায়ও এ বিষয়ে পরে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কথা জানান।
কুপিয়েছে চারজন, সাজা একজনের
দণ্ডপ্রাপ্ত সোহেলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে আদালতের নথিতে বলা রয়েছে, “তাদের সংগঠনের ‘অপস’ শাখার চারজন অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে।”
তবে আইনজীবী জাকির বলেন, “হত্যার দায়ে দণ্ডিত পাঁচজনের মধ্যে আরাফাত অভিজিৎ রায়কে কুপিয়েছিল, বাকিরা জায়গাটা ঘেরাও করে রেখেছিল। মূল পরিকল্পনাকারী জিয়াও সেখানে ছিল।”
বাকি তিনজনের ব্যাপারে বেনারকে তিনি বলেন, “আরাফাতের সাথে আলী ওরফে খলিল, অনিক এবং অন্তু নামের আরও তিনজন অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে বলে জানিয়েছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা না পায়নি তারা।”
মামলার অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে মোট ১২ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের পাঁচজনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ায় মোট ছয়জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারীরা।
উল্লেখ্য, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া মুকুল রানা ওরফে শরিফুল ২০১৬ সালের ১৯ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়।
আপিল করবেন দণ্ডিতরা
“আমরা অসন্তুষ্ট, আসামিদের আপিল করার পরামর্শ দিয়েছি,” উল্লেখ করে আসামিদের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম বলেন, “সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত হয়নি যে, তারা এবিটির সদস্য বা এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি। এমন একজন সাক্ষীও ছিল না।”
আসামিদের আরেক আইনজীবী এবিএম খায়রুল ইসলাম লিটন বলেন, “শুধুমাত্র বিভিন্ন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষীর ভিত্তিতে তাঁদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”
তবে ‘আমরা সন্তুষ্ট,” রায় প্রসঙ্গে বলেন এপিপি জাকির।
এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, “এই দেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদের কোনো জায়গা হবে না, সেই বার্তায়ই দেওয়া হয়েছে এই রায়ের মাধ্যমে।”
“জঙ্গিবাদ দমনের জন্য এই রায়টি অপরিহার্য ছিল। এর ফলে এমন অন্যায় কাজ করতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস পাবে না,” বলেন তিনি।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ থেকে ফেরার পথে রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন অভিজিৎ রায়। হামলায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন।
পরদিন রাতে অভিজিতের বাবা প্রয়াত অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে। ওই তদন্ত শেষ হতে চার বছরের বেশি সময় লাগে।
২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনসারীর আদালতে ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম।
একই বছরের ১১ এপ্রিল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ছয় আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) গ্রহণ করেন এবং পহেলা আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসের শুরুতে মামলার যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক।
বন্যার সাথে যোগাযোগ করেনি কেউ
রায় প্রকাশের পর নিজের ফেসবুকে অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা এক বিবৃতি প্রকাশ করেন।
বন্যা নিজে ওই হামলায় আক্রান্ত ও অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু মামলার তদন্তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কেউ তাঁর সাথে যোগাযোগ করেননি বলে জানান বন্যা।
তিনি বলেন, “গত ছয় বছরে, বাংলাদেশ থেকে এই মামলার তদন্তকারীদের একজনও আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। যদিও আমি ওই হামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং আক্রমণটির শিকারও।”
“গত জানুয়ারিতে, মামলার রাষ্ট্রীয় আইনজীবী প্রকাশ্যে মিথ্যা বলেছিলেন, যে আমি মামলায় সাক্ষী হতে রাজি নই। সত্য হলো বাংলাদেশের সরকার বা রাষ্ট্রপক্ষের কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি,” বলেন তিনি।
অভিজিৎ ও তাঁর প্রকাশক দীপন হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই আসামি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি ব্লগার, প্রকাশক এবং সমকামীদের হত্যাকারী এবং তাঁদের ব্যবহৃত অর্থের উৎসের সন্ধান না পাওয়া যায় তবে রায়গুলো দিয়ে কী অর্জিত হবে?
রায় প্রকাশের পর অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম মুক্তমনা ব্লগে এক বিবৃতি বলা হয়, “তদন্তকারীরা এই হত্যাকাণ্ডে ১২ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার পরেও ছয়জন চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছিল, কারণ এই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন মুকুল রানা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন তথাকথিত ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছিল।”
বন্যা আহমেদ ওই হামলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারপরেও সরকার বন্যার সাক্ষ্য নিতে “ব্যর্থ হয়েছিল” মন্তব্য করে মুক্তমনার বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা অনুভব করি যে, সরকার এই মামলাগুলো বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় চরমপন্থা নির্মূলের কোনো সৎ অভিপ্রায় ছাড়াই পরিচালনা করেছে।”
“জঙ্গিবাদ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষের অনীহা দেশের ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করে সরকারের ক্ষমতায় থাকার উদগ্র ইচ্ছাকে প্রকাশ করে,” মন্তব্য করা হয় মুক্তমনার বিবৃতিতে।
সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে “ধর্মীয় অনুভূতি লঙ্ঘনকারীদের কারাদণ্ড ও জরিমানা’ বিধানের সমালোচনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকার কেবলমাত্র অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্য লেখকদের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের ধরতে ব্যর্থ হয়নি, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসারের ক্ষেত্রে বাক-স্বাধীনতা রোধ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।”