ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যা: চারজনের মৃত্যুদণ্ড, তিনজনই পলাতক
2022.03.30
ঢাকা
বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলায় চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দিয়েছে সিলেটের আদালত। হত্যাকাণ্ডের প্রায় সাত বছর পর আলোচিত এই ব্লগার হত্যাকাণ্ডের রায় এলো।
বুধবার দুপুরে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব এ রায় ঘোষণা করেন বলে বেনারকে জানান ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি মুমিনুর রহমান। রায়ে দণ্ডিতদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন; আবুল হোসেন (২৫), ফয়সাল আহমদ (২৭), মামুনুর রশীদ (২৫) ও আবুল খায়ের রশীদ আহমদ (২৫)। এরা সবাই সিলেটের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। এদের মধ্যে আবুল খায়ের ছাড়া বাকি তিনজন পলাতক।
রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে বিতর্কিত ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে। ফারাবী ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া কারাবন্দি অবস্থায় মান্নান নামে আরেক আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার সময় শফিউর রহমান ফারাবী ও আবুল খায়ের রশীদ আহমেদকে আদালতে হাজির করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি মুমিনুর রহমান বেনারকে বলেন, “সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আসামিরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয়কে হত্যা করে।”
“এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ রকম সন্ত্রাস এবং খুন করে কেউ রেহাই পাবে না তা আবারও প্রমাণ হয়েছে,” বলেন তিনি।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেট নগরের সুবিদবাজারে নূরানী আবাসিক এলাকার নিজ বাসার সামনে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। পেশায় ব্যাংকার হলেও অনন্ত বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করতেন। এর পাশাপাশি ‘যুক্তি' নামে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এ ছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন এই ব্লগার।
হত্যাকাণ্ডের পর অনন্তের বড়ো ভাই রত্নেশ্বর দাশ বাদী হয়ে সিলেট বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে থানা পুলিশের কাছে থাকলেও পরে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়। এরপর সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর আদালতে একটি অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত তা আবার তদন্তের নির্দেশ দেন।
পুনঃতদন্তের পরে ২০১৭ সালের ৯ মে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে সন্দেহভাজন আটক ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
এই মামলার বিচারকাজ শুরুতে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে চললেও সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০২০ সালের শুরুর দিকে মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়। এই মামলায় ২৯ সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জন সাক্ষ্য দেন।
দুপক্ষই আপিল করবে
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে দুপক্ষই আপিলে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। অনন্ত বিজয়ের বড়ো ভাই রত্নেশ্বর দাশ বেনারকে বলেন, “একজন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা আপিলে যাব। এ বিষয়ে আইনজীবীদের সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”
তবে বাকি চারজনের মৃত্যুদণ্ড যেন দ্রুত নিশ্চিত হয় সে দাবি জানান তিনি।
রত্নেশ্বর বলেন, “সাত বছর আগে নৃশংসভাবে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়। সন্তানের এমন মৃত্যুতে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৯ সালে তিনি মারা যান। মাও এখন অসুস্থ। ভাই হারানোর শূন্যতা নিয়েই আমরা বেঁচে আছি। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। রায় বাস্তবায়ন হলে আমাদের পরিবার কিছুটা স্বস্তি পাবে।”
“দণ্ডিতদের তিনজনই পলাতক। তাঁদের দ্রুত আটক করে রায় কার্যকর করার দাবি জানাই,” বলেন তিনি।
রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আসামিপক্ষও।
গুরুতরভাবে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়েছে অভিযোগ এনে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুল আহাদ সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামি আবুল খায়েরের সামান্যতম সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।”
“আবুল খায়ের তখন ফেসবুক বা ব্লগ ব্যবহার করতেন না। অনন্ত বিজয়কেও চিনতেন না। তবু তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এই রায় যথার্থ হয়নি। আইনের পরিপন্থী রায় হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব,” বলেন তিনি।
স্বাধীন মত প্রকাশ স্তব্ধ করতেই হত্যা
অনন্ত বিজয় দাশকে বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ উল্লেখ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “তিনি ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। তাঁর স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারকে প্রতিহত করার জন্য এবং তাঁর লেখনীকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য সন্ত্রাসী কায়দায় তাঁকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।’
“যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান ও সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিষয়ে লেখেন বা বক্তব্য দেন, এই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ও বীভৎসতার মধ্য দিয়ে তাঁদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা ছড়িয়ে দেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য,” পর্যবেক্ষণে জানায় আদালত।
“জনমনে ভীতির সঞ্চার করে এবং জননিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে অনন্তকে হত্যা করে এই আসামিরা গর্হিত অপরাধ করেছেন, যা বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অনুজ্জ্বল করেছে। ফলে আসামিরা কোনোভাবে আদালতের অনুকম্পা পেতে পারে না,” আদালত জানায়।
“বরং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অন্যান্য সন্ত্রাসী জঙ্গি উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজন এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিত হবে,” রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়।
আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, অনন্তকে হত্যার পরপরই টুইটারে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এর দায় স্বীকার করলেও বাংলা টিম বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ সত্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রমাণ হয়নি আদালতে।
শফিউর রহমান ফারাবীকে খালাস দেয়ার বিষয়ে বিচারক জানান, হত্যার সময় ফারাবী অন্য মামলায় কারাগারে ছিলেন। সেটি আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে তাঁকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সবশেষ ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ফাঁসির রায় দেয় আদালত।
এর আগে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জঙ্গি হামলায় নিহত ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের মামলায় আদালত পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ এক ট্রাইব্যুনাল।
ব্লগার ও লেখক হত্যার সব মামলায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও অনন্ত হত্যা মামলার রায়টি ব্যতিক্রম।